ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)

প্রসঙ্গ ইসলাম

১৩২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখ বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) ইন্তেকাল করেন। ইসলামের ইতিহাসে এবং বিশ্ব দর্শনে ইমাম ইবনে তাইমিয়া এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি এক্ষেত্রে সমসাময়িক যুগে নয়া চিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটান। ইসলাম ধর্ম এবং কর্মে তাঁর যুগে কিংবা তাঁর পূর্ববর্তী যুগ থেকে সংক্রমিত হয়ে আসা বহু অনাচার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড তিনি রুখে দিয়েছেন নিজের শিক্ষা ও লেখনীর মাধ্যমে। এজন্য তাঁকে আজীবন শাসকবর্গ ও আলিম শ্রেণির মোকাবিলায় শক্তভাবে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। কিন্তু দিন যতই গড়িয়েছে, তাঁর জনপ্রিয়তা ও প্রয়োজনীয়তা ততই তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে। তাঁর দেদার দার্শনিক ও নান্দনিক চিন্তাধারা আজ ইতিহাস ধর্মালোচকদের উপকারী সম্পদ। তাই তাঁকে জানা বুঝা, স্মরণ ও বরণ করা আমাদের উচিত। 
ইসলামের ইতিহাসে নয় শুধু, অন্যান্য ইতিহাসেও দেখা যায় এমন কিছু দার্শনিক ও ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়েছেন, যাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে অফুরন্ত অবদান রেখেছেন। কিন্তু তাঁর স্বগোত্রীয় লোকেরাই তাঁকে পিছু ধাওয়া করেছে। পরে, বহু পরে আবার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বকে সবাই মিলে বরণ করে নেই। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে গোটা গোত্র, গোটা জাতি নিবেদিত হয়। নিকট অতীতে বিদ্রোহী কবি নজরুল, আল্লামা ইকবালের কথা ধরা যায়। তাঁদেরকে ধর্মান্ধ আলিম সমাজ পারেনি শুধু পিষে খেয়ে ফেলতে, অথচ আজ তাঁদের শূন্যতা যেন মুসলিম ও মুসলিম সংস্কৃতিতে অপূরণীয় হাহাকার তুলেছে। আলিম ওলামা ও যে কোনো নেতৃত্বকে তাই সংযত, দূরদর্শী হওয়া চাই। 
ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে ওলামা ও শাসকদের প্রতিবাদের মুখে অর্ধডজনেরও বেশিবার জেলজুুলুম খাটতে হয়েছে। এক পর্যায়ে এভাবেই তাঁর জীবন প্রদীপ নিঃশেষিত হয়। অথচ আজ আমরা তাঁকে দেখি একজন সংস্কারক হিসেবে, একজন আইনবেত্তা, একজন রাজনীতিজ্ঞ ও দার্শনিক হিসেবে, আমরা পাই তাঁকে একজন সফল লেখক ও গ্রন্থকার হিসেবে। আসলে মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তাচর্চার ভালো দিক ও মন্দ দিক সমাজে দুটোই রয়েছে। তাই এ বিষয়ে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু চিরতরে মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ করা মানে যে কোনো কর্মের গতিকে মাঝপথে থামিয়ে রাখা। 
ইসলামের ইতিহাসে মুক্তচিন্তার যে কজন ধারক ও বাহক ছিলেন ইবনে তাইমিয়া তাঁদের একজন। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার জন্ম ৬৬১/১২৬৩ সালে। তৎকালীন আরবের হারবান প্রদেশে। দুর্ধর্ষ মোঙ্গলদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দামেস্কে তাঁর পরিবার স্থায়ী বসবাস করতে থাকেন। তাঁর বাবা ছিলেন দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বাবার মৃত্যুর পর আপন শিক্ষা-দীক্ষা ও অসাধারণ ধী শক্তি গুণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই পদ অলংকৃত করেন। খুব স্বল্প সময়ে তিনি দামেস্কের সুধী সমাবেশে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি ছিলেন হাম্বলী মাযহাবভুক্ত। অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রধান যে চারটি বিশুদ্ধ মাযহাব, তিনি তাদের একটি বা হযরত ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.)-এর অনুসারী ছিলেন। কিছু ইসলামী স্কলার ইমাম ইবন তাইমিয়াকে চার মাযহাবের বাইরে একজন মুক্তচিন্তার মনীষী হিসেবে বর্ণনা করেন। তারা এও বলেন, তিনি মাযহাব বিশ্বাস করতেন না বলেই প্রচুর পরিমাণে মুক্তবুদ্ধি প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন ইসলামী আইন ও শরিয়তে। 
সে যাই হোক, একজন মশহুর বক্তা হিসেবেও ইমাম ইবনে তাইমিয়ার প্রচুর খ্যাতি ছিল। তিনি প্রতি জুমাবার দামেস্কে ইতিহাসখ্যাত মসজিদে জুমার খুতবা দান করতেন। তাফসির, হাদিস ও ফিকাহশাস্ত্রে অসামান্য দখল থাকায় তিনি কুরআন ও সহীহ হাদিসের অপূর্ব ব্যাখ্যা দিতেন এবং দুর্বল (জয়িফ) হাদিসের সমালোচনা করতেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনী আর যৌক্তিক আলোচনাতে বিরুদ্ধবাদীরা হার মানত এবং আক্রোশে ফেটে পড়ত। তাঁর মাযহাব ও আদর্শ বিরোধীরা এক পর্যায়ে দামেস্ক ছাড়া, চাকরিহারা করেছে তাঁকে। তিনি মদিনা হয়ে কায়রোতে আশ্রয় নেন, এখানেই তিনি জীবনে এই প্রথম আদালতে বিচারের সম্মুখীন হন এবং কারারুদ্ধ হন। এরপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি ফের দামেস্কে আসতে সক্ষম হন। অবশ্য সবখানেই যে তিনি কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন তা নয়, বহু জ্ঞানী-গুণী ও বিদ্যানুরাগী রাজন্যবর্গে তিনি পৃষ্ঠপোষকতাও লাভ করেছিলেন। 
১৩২৬ সালে দামেস্কে প্রবল ওলামা বিক্ষোভের মুখে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েদখানায় বসে বসে তিনি তাঁর লেখনী অব্যাহত রাখেন। তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা যখন জানতে পারল যে, জেলের মধ্যেও ইবনে তাইমিয়া তাঁর মতামত ও ধ্যানধারণা লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছেন, তখন তাঁর কাছ থেকে সমস্ত পা-ুলিপি, স্ক্রিপ্ট ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে নিষ্কর্মা জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়। এটা হলো তাঁর পক্ষে চরম আঘাত। এরপরও তিনি অহরাত্র কুরআন তিলাওয়াত ও নামাজ রোজা জিকির আযকারে মশগুল থাকতেন। দারুণ মানসিক আঘাতে ভেঙে পড়েন। অবশেষে কারারুদ্ধ হওয়ার দু’বছরের মাথায় ইহধাম ত্যাগ করেন। ইতিহাস বলছে, গোটা দামেস্ক জুড়ে নেমে আসে তখন শোকের ছায়া। তাঁর জানাজায় ২ লাখ পুরুষ এবং ১৫ হাজার নারী তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সমবেত হয়েছিলেন। 
শুধু মনীষী ইবন তাইমিয়া নয়, যুগে যুগে যাঁরা হক কথা বলে বা সত্যের পথে অবিচল থেকে নিজের মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যান, তাঁদের পথচলা কখনো অনুকূল থাকে না। তাঁরা নিগৃহীত হন সমসাময়িক অনুদার, পরশ্রীকাতর তথাকথিত প-িতশ্রেণি ও শাসকবর্গের হাতে। কিন্তু সময় যত গড়িয়ে যায়, মহামনীষীদের নির্যাতন ভোগের মাত্রাও যখন শেষ হয়, অশেষ অবদান রেখে প্রচ- ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁরা যখন পরপারে পাড়ি জমান, তখনই পুষ্পমাল্য নিয়ে এগিয়ে আসে পরবর্তী জ্ঞানপিপাসু জাতি। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, ইমাম বুখারী (রহ.) সকলের ইতিহাস এমনি মর্মন্তুদ, এমনি এক ও অভিন্ন। 
চলুন আমরা পরমত সহিষ্ণু হই, অন্যের কথা, কর্ম ও চিন্তা অনুধাবন আর শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে উদার মনমানসিকতা প্রদর্শন করি। তাহলে এ বসুন্ধরা আরও বেশি উপকৃত হবে তার  যোগ্য সন্তানদের অবদানে। দার্শনিক ইবনে তাইমিয়ার কিছু কালোত্তীর্ণ বাণী রয়েছে। তিনি বলতেন আমার শত্রুরা আমার কিইবা করতে পারবে? আমার জান্নাত তো আমার অন্তরে। আমি যেখানেই যাই সে আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে, আমার থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হয় না। কারাগার আমার ইবাদতের জন্য নির্জন আশ্রয়স্থল, মৃত্যুদ- আমার জন্য শাহাদাতের সুযোগ, আর দেশ থেকে নির্বাসন হচ্ছে আমার জন্য এক আধ্যাত্মিক ভ্রমণ। 
তিনি বলেছেন কারও ওপরে বেশি নির্ভরশীল হয়ে যেও না। মনে রেখ, অন্ধকারে তোমার নিজের ছায়াও তোমাকে ছেড়ে চলে যায়। আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা আর নিজেদের মাঝে বিভক্ত না হয়ে যাওয়া ইসলামের সবচেয়ে বড় উসুল বা বুনিয়াদের একটি। তিনি আরও বলেছেন, জ্ঞানার্জন ছাড়া দিক নির্দেশনা অর্জন করা যায় না। আর সবর ছাড়া সঠিক পথের দিশা অর্জন করা যায় না। 
- (মাজমুআল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া ও আল ওয়াবিল, ইবনুল কায়্যিম)। 
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×