
একটি গুলি মুহূর্তেই শেষ করে দিতে পারে একটি প্রাণ। তার দেহ নিথর হয়ে যায়, কণ্ঠ থেমে যায়, চিন্তার গতি থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু একটি কলম—যদি তা সাহস ও সততায় সজ্জিত হয়—সে পারে হাজারো প্রাণকে জাগিয়ে তুলতে, একটি জাতিকে পথ দেখাতে এবং একটি সভ্যতার বিবেক হয়ে উঠতে।
এই পার্থক্যটি যতটা বাস্তব, ততটাই গভীর। কারণ গুলি থামিয়ে দেয়, আর কলম শুরু করে। গুলি করে মৃত্যু, আর কলম সৃষ্টি করে চেতনা।
বিশ্ব ইতিহাসে প্রতিটি বড় পরিবর্তনের পেছনে কলমের এক অনিবার্য ভূমিকা রয়েছে। ফরাসি বিপ্লব, মার্কিন স্বাধীনতা, ভারতীয় উপমহাদেশের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন—এই প্রতিটি আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলো কিছু দৃষ্টান্তমূলক লেখা, কিছু মহৎ মননের ভাষ্য। একটি লেখা কতটা শক্তিশালী হতে পারে, তা বুঝতে হলে ফিরে যেতে হয় সোভিয়েত গুলাগ থেকে শুরু করে ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লব, কিংবা নিজস্ব বাস্তবতায় আমাদের ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত।
তখনও গুলি চলেছিল, কিন্তু ইতিহাস মনে রেখেছে সেইসব কণ্ঠকে যারা কলমে লিখেছিল, “আমি বাংলায় গান গাই”, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”।
আজকের পৃথিবী আরেকটি বর্ণচোরা সময় পার করছে। গণমাধ্যমের একাংশ পরিণত হয়েছে পুঁজির মুখপাত্রে। রাজনীতি এখন আর আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত নয়, বরং তা অধিকাংশ সময়েই কৌশল ও কর্পোরেট সুবিধার গোলকধাঁধা। কূটনীতি এখন মানবতা নয়, বরং ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ছলনায় পরিণত হয়েছে।
এই বাস্তবতায় একজন লেখকের দায়িত্ব শুধু সমাজ পর্যবেক্ষণ নয়—সেই সমাজের সামনে আয়না ধরে সত্য তুলে ধরা। কলম এখন আর শুধু সাহিত্যিক অনুশীলনের মাধ্যম নয়, এটি এখন প্রতিরোধের একমাত্র অগ্নিস্রোত।
আজ যখন গাজা কিংবা রোহিঙ্গা শিবিরে শিশুদের কান্না স্তব্ধ করে দেয় বিস্ফোরণের ধ্বনি, তখন শুধুমাত্র কলমই পারে সেই কান্নাকে ভাষা দিতে। যখন রাষ্ট্রক্ষমতার বলয়ে গুম হয় সাংবাদিক, মুছে ফেলা হয় ইতিহাস, অথবা বিকৃত হয় সত্য, তখন সাহসী একটি কলমই দাঁড়ায় ন্যায়বিচারের পক্ষে।
এখানেই লেখক আর সাধারণ নাগরিকের পার্থক্য। একজন সাধারণ মানুষ হয়তো নিজে বাঁচার চিন্তা করে, কিন্তু একজন লেখক—যদি তিনি প্রকৃত লেখক হন—তাহলে তিনি গোটা জাতির মুক্তি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চেতনার জন্য লিখে যান।
আমরা এখন এমন এক সময় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে সত্য বলা নিজেই এক বিপ্লব। লেখকের কাঁধে আজ জাতির বিবেকের ভার। সাহসী লেখালেখি মানেই এখন আদর্শিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া মানেই মিথ্যার পক্ষে নীরব সম্মতি দেওয়া।
সুতরাং, কলমকে অবহেলা করার আর সুযোগ নেই। এখন কলমকে হতে হবে বিশ্লেষণমূলক, সাহসী ও গণবোধসম্পন্ন। কলমকে হতে হবে এমন—যা প্রশ্ন তোলে, কিন্তু অপমান করে না; যা নির্ভীক হয়, কিন্তু উদ্দেশ্যহীন হয় না।
একটি কলম কখনো কেবল লেখার জন্যই লেখা নয়। এটি ইতিহাসের প্রতিধ্বনি, সত্যের মুখপাত্র এবং বিবেকের জ্বলন্ত আলো।
আজকের সময় চায় এমন কলম, যা শ্রুতিমধুর নয়, বরং হৃদয়বিদারক সত্যকে তুলে আনে সাহসিকতায়। যা আরামদায়ক নয়, বরং প্রয়োজনীয়। কারণ ইতিহাস মনে রাখে সেই লেখককে, যার কলম সময়কে জয় করতে জানে।
লেখক ও কলামিস্ট: জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
নোভা