
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গত ৫৩ বছর আওয়ামী বাকশালী, ফ্যাসিবাদ কায়েমের বহুমাত্রিক প্রয়াস দেখেছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে উন্নত আদর্শ দিয়ে মোকাবিলা করতে না পেরে, পেশিশক্তি দিয়ে ঘায়েল করতে, এই মাফিয়া গোষ্ঠীর প্রধান অস্ত্রই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ভারতীয় মদদপুষ্ট আওয়ামী মাফিয়াতন্ত্রের চরিত্রে জন্মসূত্রেই ফ্যাসিবাদের বীজ বপিত ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২-৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম পরিণতির হাত ধরে বিকশিত হয়েছে এবং ডালপালা মেলেছে, পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছে সাড়ে ১৫ বছরের (২০০৯-২৪) শাসনকালে। কী করেনি তারা তাদের শাসনকালে! গুম, খুন, গণহত্যা, বিচারিক হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, শেয়ারবাজার, ব্যাংক লুট ও দখল। মানুষের সমাজ জীবনে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তারা করেনি।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে, খেটে খাওয়া দিনমজুর বাবার মাটির ঘরে জন্ম নেন, একুশ শতকের এই আলোকিত বিপ্লবের কাণ্ডারি আবু সাইদ। নয় ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতেন এবং বাবা-মাকেও আর্থিক সহযোগিতা করতেন।
উত্তরের উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের এই অসীম সাহসী আবু সাঈদ নিজ বিশ্বিবিদ্যালয়ের একজন অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। দেশব্যাপী কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে, অকুতোভয় এই লড়াকু সৈনিক বুক চিতিয়ে একাই পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে যান, ফ্যাসিবাদী হাসিনার পুলিশ ২০২৪-এর ১৬ জুলাই, খুব কাছ থেকে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় গুলি করে খুন করে সাঈদকে।
আবু সাঈদের রক্তরাঙা রাজপথ দেশজুড়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করে। পরের ইতিহাস আমাদের জানা। ভারতীয় মদদপুষ্ট, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনের সূর্য্য অস্তমিত হবে, এমনটি কখনো ভাবেনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু ছাত্র সমাজ থেকে উঠে আসা আবু সাঈদরাই নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। আমরা দৃঢ়চিত্তে মনে করি, এখন থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, ‘বৈশ্বিক বিপ্লবের প্রতীক’ হিসেবে আলোর বাতিঘর হয়ে থাকবেন আবু সাঈদ। বন্দুকের সামনে হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দেওয়া আবু সাঈদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই প্রায় হাজারো ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে হাসিনা রেজিম কথিত বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে পালিয়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা, পুরো পার্লামেন্টের ৩শ সদস্য, স্পিকার ও মন্ত্রিপরিষদসহ পলায়ন। এমনকি জাতীয় মসজিদের খতিবও পালিয়ে জীবন বাঁচান। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির খুব কমই আছে। ‘কোটা সংস্কার’ থেকে ‘গণ-অভ্যুত্থানের’ মহানায়ক আবু সাঈদ। তার আত্মত্যাগেই আন্দোলনকারীদের বিবেকের বাঁধ খুলে দেয়। আওয়ামী বাকশালী মাফিয়াতন্ত্রের ফ্যাসিবাদী ইমারতের দম্ভ চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। হাসিনার পতন ঘণ্টা তখনই বেজে উঠেছিল। যার পরিসমাপ্তি ঘটে ৫ আগস্ট, ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ২৪-এর অক্টোবর ও নভেম্বরে দুই ধাপে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ, বিচার, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন এবং দ্বিতীয় ধাপে স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রম, নারী, স্থানীয় সরকারসহ মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। আমাদের বিশ্বাস আগামীর বাংলাদেশ হবে বৈষম্যমুক্ত, আবু সাঈদের স্বপ্নের বাংলাদেশ।
প্যানেল/মো.