
ঋতু বৈচিত্র্যের চিরস্থায়ী রূপশৌর্যে আবহমান বাংলা ও বাঙালি। ষড়ঋতুর নির্মল বাতাবরণের শাশ্বত বঙ্গভূমির যে সৌন্দর্য, লাবণ্য তাও বরেন্দ্র অঞ্চলের অনবদ্য শক্তি আর মাধুর্য। দ্বিজেন্দ্র লাল রায় আরও গভীর নিবেদন-অনুভবে কল্পনায় এনেছেন
এমন দেশটি কোথাও
খুঁজে পাবে নাকো তুমি।
সকল দেশের রানী সে যে
আমার জন্মভূমি।
আর নৈসর্গের কবি জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলায়’ আবহমান বঙ্গভূমির যে শাশ্বত নান্দনিকতা তাও যেন প্রকৃতির অনন্য বরমাল্য।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ‘দুই বিঘে জমি’তে মাতৃভূমির বন্দনায় যেন ব্যাকুল, দিশাহারা।
নমো নমো নমো সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি,
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি?
অবারিত মাঠ, গগন ললাট, চুমে তব পদধূলি
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।
আর বিদ্রোহী কবি নজরুলও চারণ কবির মাহাত্ম্যে বাংলার পথঘাট, ধূলিকণার যে সচিত্র কাব্য উপহার দিয়েছেন তাও সৌন্দর্যস্নাত বাংলার মনোমুগ্ধকর শোভা, ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতায় অনুভব করছেন গ্রাম বাংলার চিরন্তন রূপশৌর্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভবের বহুমাত্রিক লীলাখেলা।
‘চমকিয়া জাগি ললাটে আমার কাহার নিশ্বাস লাগে?
কে করে ব্যজন তপ্ত ললাটে, কে মোর শিয়রে জাগে?
জেগে দেখি মোর বাতায়ন পাশে জাগিছে স্বপনচারি,
নিশীথ রাতের বন্ধু আমার গুবাক তরুর সারি।
সারি সারি নারকেল আর সুপারি গাছের চমকপ্রদ বাহারে
চিরায়ত পল্লী জননীর সৌন্দর্য স্নানের অবগাহন।
আর বর্ষার প্রবল বারিধারায় তেমন মাধুর্যমণ্ডিত প্রতিবেশ ভাবুক হৃদয়কে আলোড়িত করাও রূপময় এক বর্ণিল ছবি। বর্ষার শীতল হাওয়ায় জনজীবন অনেকটা স্বস্তি আর শান্তির প্রলেপে স্নিগ্ধ বাতাবরণকে আলিঙ্গন করছে। যে কোনো অবস্থার ইতি আর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বিজ্ঞানভিত্তিক এক পরম বার্তা। যাপিত জীবন আর নিত্য সহচর প্রকৃতি-পরিবেশও তার অনুষঙ্গ হতে সময় নেয় না। বৃষ্টি বিধৌত গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল এখন বর্ষণের ক্লান্তিহীন প্রকৃতিকে মেনে নিয়ে জীবনের গতিময়তায় এগিয়েও যাচ্ছে। আবার পানিস্নাত এই ক্ষুদ্র বরেন্দ্র অঞ্চলের জলস্রোতের প্রভাব প্রতিপত্তিও লক্ষণীয়। নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবন এক চরম অস্থিরতায় আবর্তিত। শুধু কি ঝরো ঝরো বারি ধারা? তার চেয়ে বেশি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে চলে আসা উপকূলীয় অঞ্চল এখন এক ঘোর দুর্বিপাকে। শুধু কি পানির বেগ বেড়ে যাওয়া? সংশ্লিষ্ট বন্যাকবলিত এলাকায় জন জীবনের চরম দুর্বিপাক নতুন কিছু নয়। সমুদ্র পরিবেষ্টিতও নদী বিধৌত পলিমাটির এই বরেন্দ্র অঞ্চল যুগ-যুগান্তরের এক অসম সাহসী জাতিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণই শুধু নয়, লড়াকু জীবন সংগ্রামের অংশীদারিত্বে নিজেদের টিকিয়ে রাখাও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক গতিপ্রবাহ। যেমন রূপশৌর্যের অপরূপ মাহাত্ম্যে ধনে ধান্যে, ফুল, ফলে ভরা বাংলায় ভাঙনের খেলাও নিত্য দুর্ভোগের আর এক যাতনা। প্রাকৃতিক উপহার আর বিপর্যয়ের সম্মিলিত ধারায় দেশের যে শস্য ভাণ্ডারের চিরন্তন গৌরব আবার ভাঙনের উন্মত্ততায়ও জনগোষ্ঠীর বিপন্নতার শেষ পরিশেষ থাকেই না। আমরা এখন বর্ষণক্লান্ত বারিধারার সিক্ত স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ পরিস্থিতিকে সামলিয়ে নিত্য জীবন যাপনে কখনো সহনীয় কিংবা বিপত্তির জালে আটকে যাচ্ছি।
প্রকৃতির এমন নিষ্ঠুর খেলায় উপকূলীয় আর গ্রামীণ জনপদও প্লাবনের স্রোতে ভেসে যায়Ñ বাস্তুচ্যুত জনগণও চরম বিপত্তিতে স্থানান্তরে বাধ্য হয়। আবার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে সাময়িক বসতি স্থাপন করে। নাওয়া খাওয়া নিয়ে চিন্তার কোনো অবকাশই থাকে না। অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটানো বানভাসি অসহায় মানুষের বর্ষণমুখর আবহাওয়ায় কোনো কাব্য কিংবা সংগীতের মূর্ছনা অনুরণিত হয়ই না। বাস্তুভিটা আর জীবন বিপন্নের আর্তনাদে যে বিষাদঘন অনুভব সেটা ষড়ঋতুর এই দেশের চিরস্থায়ী এক যাতনা, দুর্ভোগ, সংশ্লিষ্ট উপকূলীয় অঞ্চলবাসী তেমন দুর্বিষহ লড়াইয়ের আবর্তে পতিত হতে যেয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিবৃত্তও নজর কাড়া।
লড়াই করার নিত্য অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ এমন সাধারণ মানুষদের যে দুঃসাহসিক অভিযাত্রা সেটাও অঞ্চলগত বৈশিষ্ট্যের নৈমিত্তিক জীবনের ঘানি টানা।
আবার শস্য শ্যামল উর্বর পলিমাটির এই অঞ্চলে মাছে-ভাতে বাঙালির যে চিরায়ত কর্মযোগ সেটাও বরেন্দ্র ভূমির মাটি ও মানুষের নিত্য জীবনের অনুগামী, অনুষঙ্গ যাই বলি না কেন। শত ভাঙা গড়ার উত্থান পতনে সমুদ্র ও নদীমাতৃক এই দেশের মৎস্য সম্পদ বিশ্বে নজরকাড়া, রুপালি ইলিশের এই পদ্মার চারণ ভূমির জগৎ জোড়া খ্যাতি যুগ-যুগান্তরের। ইতোমধ্যে ইলিশের মৌসুম তার শুভযাত্রার পথে। আর ভরা ইলিশের অনন্ত সম্ভার ভাদ্র মাসের জন্যই বরাদ্দ। তবে শ্রাবণের ইলিশও সুস্বাদু কিন্তু আকারে ছোট থাকে। সেখানে বহুমাত্রিক মৎস্য সম্পদে ভরপুর বাংলার ইতিবাচক প্রতিবেশ ষড়ঋতুর বিচিত্র রূপময়তায় যেন শাশ্বত বঙ্গভূমির নৈসর্গের পরম উপহার। শুধু কি আমাদের চাহিদা মেটায়? বিদেশে রপ্তানি করেও প্রচুর মুদ্রা অর্জন অঞ্চলগত আর এক অর্থ সম্পদের সমৃদ্ধ বাতাবরণ। যা জনগোষ্ঠীর নিত্য আহারেরও নিয়ামক শক্তি।
তবে দেশের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাতে যে বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কিত পর্যায় সেটা মোকাবিলা করতে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর যে দুর্দশা, দুর্ভোগ তাও কোনো অংশে কম নয়। বন্যাকবলিত সংশ্লিষ্ট জেলার পানি কমে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু বৃষ্টিপাতের পরিবেশ সেভাবে সহনীয় নয়। আবার এমন দুঃসহ তথ্য ও গণমাধ্যমের পাতা ভারি করছে বছর না যেতেই বন্যাদুর্গত এলাকা পুনরায় পানিবন্দিতে দুরাবস্থায় পতিত হওয়ার অপদৃশ্যও সহনীয় নয়।
এমন সব তথ্য ঋতু বৈচিত্র্যের এই অঞ্চলের নতুন কিছু নয়। সেই পুরানো বোতলে নতুন মদ ঢালার মতো। ঐতিহ্যক বঙ্গভূমি সঙ্গতকারণে লড়াই বিপ্লবের এক কঠিন বাতাবরণে আবর্তিত। সেখানে নৈসর্গের সংহার তো রয়েছেই, পাশাপাশি মানুষের নিত্যনতুন যান্ত্রিক সভ্যতার অভিগমনও বিপরীত প্রদাহ তৈরিতে অনেকটাই নাকি এগিয়ে থাকে। প্রযুক্তি নিয়তই উদ্ভাবনে মানুষের জীবন যাপনকে স্বস্তি আর শান্তি দিলেও হরেক বৈপরীত্যকেও নির্মম নৈসর্গের বাতাবরণে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যা নাকি দূষণের মাত্রাকেও অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। সদা ক্রিয়াশীল প্রকৃতির কাছে লালিত সন্তানরা আসলেই অসহায়। কখনো নৈসর্গকে অবারিত দানে ভরিয়ে দিচ্ছে। আবার প্রতিশোধের স্পৃহায় কোলের সন্তানদের নাজেহাল করতেও পিছু হটছে না। তবে নিসর্গ বিজ্ঞানীরা সতর্কবাণী দিচ্ছেন প্রকৃতি নয় মানুষের সৃষ্ট যন্ত্রসভ্যতাই তার বিপরীত প্রদাহে নৈসর্গকে নয় ছয় করে দিয়ে তথ্য-প্রযুক্তির আঙিনাকে বিভিন্নভাবে আলিঙ্গন করছে। সেখানেই লাগাম টেনে ধরতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনেরা অভিমত-পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। নৈসর্গ সহায়ক যন্ত্র উদ্ভাবনও নিতান্ত জরুরি। তাহলে আগামীর বিশ্ব বাসযোগ্য থাকবে কি না তাও এক রুদ্ধতার বেষ্টনী। সঙ্গতকারণে কোলের সন্তানদেরই যৌক্তিক আর মানবিক হয়ে সংহার সুতি পরিহার করা বাঞ্ছনীয় তাতে প্রকৃতি নিজেই পরিশুদ্ধ হতে সময় নেবে না।
প্যানেল/মো.