
.
বৈশ্বিক মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। যেখানে প্রায় প্রতি বছরই ছোট-বড় বন্যা হয়ে থাকে। যার ফলে অর্থনীতি, অবকাঠামো ও জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতি হয়। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবিলা করতে প্রয়োজন সময়োপযোগী সঠিক তথ্য। এক্ষেত্রে উপগ্রহ চিত্র এবং কার্যকর ওয়েবসাইট প্ল্যাটফর্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উপগ্রহ চিত্র, বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ত্রাণ কার্যক্রমে অসাধারণভাবে সহায়ক। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর থেকেই বাংলাদেশে উপগ্রহ চিত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছিল এবং বর্তমানেও এর গুরুত্ব ক্রমে বাড়ছে প্রযুক্তির কল্যাণে।
উপগ্রহ চিত্র ব্যবহার করে বন্যার বিস্তৃতি, গভীরতা এবং গতিপথ পর্যবেক্ষণ করা যায়। রিয়েল-টাইম ডেটা এবং উচ্চ-রেজুলিউশনের ছবি বন্যার একটি বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে বন্যার পূর্বাভাস মডেল উন্নত করা সম্ভব, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপকদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
উপগ্রহ চিত্র দুর্গম বা বিচ্ছিন্ন এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর পথ নির্ধারণে সহায়ক। বন্যা যেহেতু বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত করে, তাই উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত করা গেলে উদ্ধারকারী দল ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে খুব দ্রুত পৌঁছাতে পারে এবং ত্রাণ বিতরণও আরও সহজ হয়। সাধারণত দেখা যায় যে, উপগ্রহ চিত্র ব্যবহার না করা হলে, যেসব প্লাবিত অঞ্চলে অভিগম্যতা বেশি, সেখানে উদ্ধার সুবিধা ও ত্রাণ বেশি পাওয়া যায়
বন্যা-পরবর্তী সময়ে উপগ্রহ চিত্র ব্যবহার করে কৃষি জমি, অবকাঠামো (সড়ক, সেতু, বাড়িঘর) এবং জনবসতির ক্ষয়ক্ষতি নির্ভুলভাবে নিরূপণ করা যায়। কোনো অঞ্চল কতদিন প্লাবিত ছিল, সেটা একমাত্র উপগ্রহ চিত্র দিয়ে সহজে নির্ণয় করা সম্ভব। এটি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের পরিমাণ অনুমান করতে সাহায্য করে।
বন্যার ধরন ও প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা যেমন- বাঁধ নির্মাণ, নদী খনন এবং বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনে উপগ্রহ চিত্র অপরিহার্য তথ্য সরবরাহ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যখন বন্যার তীব্রতা বাড়ছে, তখন উপগ্রহ ডেটা-নির্ভর পরিকল্পনাগুলো আরও বেশি জরুরি।
তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অনেক সময় বন্যা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বন্যা মানচিত্র প্রণয়নের জন্য গবেষণা করা হয়। গবেষণার অবশ্যই দরকার আছে, যা তাৎক্ষণিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ততটা সহায়ক না হলেও ভবিষ্যতের জন্য খুব কাজে আসতে পারে। সঠিক সময়ে নির্ভুল মানচিত্র প্রয়োজন, কারণ যত নিখুঁতভাবে মানচিত্রায়ন হবে, দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা তত বৃদ্ধি পাবে। একসময় টাকা দিয়ে উপগ্রহ চিত্র কিনতে হলেও এখন দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য অনেক বিনামূল্যে উপগ্রহ চিত্র পাওয়া যায়, যা সঠিক সময়ে ব্যবহার করা গেলে অনেক বেশি লাভবান হওয়া যাবে। দুর্যোগের আগে, দুর্যোগ চলাকালীন এবং দুর্যোগের পরেও উপগ্রহ চিত্র গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ বন্যার পরে কোনো স্থান কতদিন প্লাবিত ছিল, তা উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে সহজেই নির্ণয় করা যায়। এছাড়াও প্রতি বছর যেসব স্থান বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে, সেগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করতে নিয়মিত (মাসিক বা বার্ষিক) উপগ্রহ চিত্রের মানচিত্রায়ন খুবই জরুরি।
এই তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোর কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য কার্যকর ওয়েবসাইট প্ল্যাটফর্ম থাকা অত্যন্ত জরুরি। দেশে ওয়েবসাইট নেই সেটাও বলা ঠিক হবে না। যেমন বাংলাদেশে যখন কোনো দুর্যোগ ঘটে, তখন মানুষ প্রায়ই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে যায়, কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় সেখানে দুর্যোগ সম্পর্কিত পর্যাপ্ত বা সময়োপযোগী তথ্য থাকে না। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের পূর্বাভাস বা বর্তমান অবস্থা সম্পর্কিত কোনো সুস্পষ্ট লিঙ্ক প্রায়ই অনুপস্থিত, কেবল প্রশাসনিক বিষয়াবলীই সেখানে বিদ্যমান।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান ওয়েবসাইটে প্রশাসনিক বিষয় থাকলেও, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস এবং পূর্ব সতর্কতা ওয়েবসাইটটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং তথ্যবহুল। এ ধরনের ওয়েবসাইটগুলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এমন সমৃদ্ধ ওয়েবসাইটগুলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের সঙ্গে লিঙ্ক করা যেতে পারে, যাতে মানুষ একটি কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্মে সব তথ্য খুঁজে পায়। একইভাবে, আবহাওয়া বিভাগ যেসব পূর্বাভাস প্রদান করে, সেগুলোও যদি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে মানুষ একটি ওয়েবসাইটে তথ্য না পেলে অন্য ওয়েবসাইট থেকে সহজে প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারবে। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য তথ্য উৎসকে একটি একক, সহজে ব্যবহারযোগ্য প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা গেলে তা দুর্যোগকালীন সময়ে তথ্যপ্রাপ্তি সহজ করবে এবং সমন্বিত ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করবে।
উপগ্রহ চিত্র ও কার্যকর ওয়েবসাইট প্ল্যাটফর্ম, এই দুটি শক্তিশালী মাধ্যম বাংলাদেশের বন্যা মোকাবিলায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। এর সঠিক এবং সময়োপযোগী ব্যবহার দেশের দুর্যোগ সহনশীলতা বৃদ্ধি এবং জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখবে। এই সমন্বিত উদ্যোগ বাংলাদেশের মতো বন্যাপ্রবণ দেশকে ভবিষ্যৎ দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে।
লেখক : ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, ইসিমোড, নেপাল
প্যানেল/জোবায়ের