ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

অনুমোদনহীন দরপত্রে ২১৬ কোটি টাকার পিল কেনার তোড়জোড়

আল জুবায়ের

প্রকাশিত: ১২:০৪, ১৬ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৮:৫৫, ১৬ জুলাই ২০২৫

অনুমোদনহীন দরপত্রে ২১৬ কোটি টাকার পিল কেনার তোড়জোড়

ছবিঃ সংগৃহীত

এক বছর ৬ মাস আগে বাতিল হওয়া দরপত্রে গোপনে ২১৬ কোটি টাকার জন্মনিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত খাবার বড়ি কেনার তোড়জোড় শুরু করেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। কার্যকর প্রতিযোগিতার অভাবে গত বছর ১৩ মার্চ এই দরপত্র বাতিল হয়। তবে হঠাৎ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সংকট দেখা দেওয়ায় বাতিল হওয়া দরপত্রের ভিত্তিতে পছন্দের কোম্পানির কাছ থেকে খাবার বড়ি কেনার প্রচেষ্টা চলছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি মাসের ১০ তারিখে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কার্যালয়ে একটি সার সংক্ষেপ পাঠানো হয়। এতে দেখা যায়, বিশেষ কোম্পানিকে কাজ দিতে বাতিল হওয়া দরপত্রের শর্ত শিথিল করা হয়। এমনকি আইনবহির্ভূত অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এর আগে অবৈধভাবে গত বছর ৮ অক্টোবর শর্ত শিথিল করে বাতিল হওয়া দরপত্রে খাবার বড়ি কেনার জন্য প্রস্তাব পাঠায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।

এসব খাবার বড়ি আগে বিদেশি অর্থায়নে কেনা হতো। তবে স্বাস্থ্যখাতের অপারেশনাল প্লান বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সেক্টর কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২১৬ কোটি টাকার খাবার বড়ি কেনার অনুমোদন দেয়নি সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি। এবার সরকারি টাকা দিয়ে এই বড়ি কেনার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছে অধিদপ্তর। বিশেষ কোম্পানিকে কাজ দিতে অবৈধভাবে বারবার প্রস্তাব পাঠাচ্ছে অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা।

এদিকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, একবার দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর পুনঃদরপত্র আহ্বান না করে আগের দরপত্র পুনর্বহালের সুযোগ নেই। এটি আইনবহির্ভূত। পুনঃদরপত্র আহ্বান ছাড়া আগের দরপত্র নিয়ে টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন (দরপত্র পুনর্মূল্যায়ন) কমিটি কোনোভাবেই বৈঠক করতে পারে না।

জাতীয় ক্রয়নীতি ২০০৬-এর ১৯.১ সেকশন অনুযায়ী, টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটি ও ক্রয় কমিটি সরবরাহকারীকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (কার্যাদেশ) না হওয়ার আগ পর্যন্ত যেকোনো প্রয়োজনে দরপত্র বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু যদি একবার দরপত্র বাতিল হয়, তাহলে নতুন দরপত্র আহ্বান ছাড়া আগের দরপত্রে কোনোভাবেই কেনাকাটার সুযোগ নেই। বাতিল হওয়া দরপত্র পুনর্বহালের চেষ্টা করাও বেআইনি।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মুখে খাওয়ার পিলের (খাবার বড়ি) মজুত দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও (সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট পোর্টাল) জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে বর্তমানে দেশের সব উপজেলায় মুখে খাওয়ার পিল বড়ির মজুত শেষ। এই সংকট নিরসনে জরুরিভিত্তিতে মুখে খাওয়ার পিল কেনাকাটার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ২ জানুয়ারি পাঁচটি লটে প্রায় ২১৬ কোটি টাকার বেশি উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। সাতটি কোম্পানি সেখানে দরপত্র জমা দেয়। তবে মাত্র তিনটি কোম্পানি দরপত্রের শর্ত পূরণ করতে পারে। ১, ২ ও ৩ লটে দরপত্র জমা দেয় বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি রেনেটা লিমিটেড ও টেকনো ড্রাগস লিমিটেড। আর ৪ ও ৫ লটে শুধু মাত্র পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড শর্ত পূরণ করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর ১৩ মার্চ টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটি কার্যকর প্রতিযোগিতার অভাবে এই পাঁচটি লটের দরপত্র বাতিল করে দেয়। এমনকি দরপত্রে অংশ নেওয়া কোম্পানিগুলোর ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। কোম্পানিগুলো ব্যাংক গ্যারান্টির টাকা তুলে নেয়। সেই সময় টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেগম সাহান আরা বানু। তার চাকরির বয়স শেষ হওয়ায় মার্চে তিনি অবসরে যান। বর্তমানে এই পদে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. আশরাফী আহমদ এনডিসি। তবে তিনি এই দরপত্র আগে বাতিল হওয়ার বিষয়ে কিছুই জানেন না।

অভিযোগ উঠেছে, বেআইনিভাবে এই দরপত্র অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও হেড প্রকিউরমেন্ট অথরিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। এদিকে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার সরকারের পতনের পর স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের ব্যাপক রদবদল দেখা যায়।

বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ) মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, "আমি নতুন, ১৭ জুন এখানে যোগদান করেছি। আমরা কোর্টের মামলার কপি, আইন ও ফ্যাক্টসহ সবকিছু ফাইল আকারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সচিব স্যারের কাছে পাঠিয়েছি। আমাদের আর কিছু করার নেই, এখতিয়ারও নেই। পরিবার কল্যাণ অধিদপ্তর থেকে কোন মতামত দেওয়ারও সুযোগ নেই। সবকিছু চলে আইন অনুযায়ী। মন্ত্রণালয় থেকে সচিব স্যারের ওখানে ডিসিশন মেকিং (সিদ্ধান্ত) হবে।"

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আশরাফী আহমদ বলেন, গত বছর বাতিল হওয়া টেন্ডার পুনরায় উজ্জীবিত করে পণ্য কেনার প্রক্রিয়া চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তার জানা নেই। ওই সময় একটি রীট হয়েছিলো। কিন্তু পরে কী হয়েছে সেটি তিনি জানেন না। বাতিল হওয়া টেন্ডার নিয়মের বাইরে গিয়ে পুনর্জীবিত হওয়ার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) ও জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, "যেটা আগের ডিজি বাতিল করে গেছেন, আরেক ডিজি এসে রাতের আঁধারে সেটা পুনর্বহাল করবেন—এটা ঠিক নয়। যেহেতু আগের দরপত্র বাতিল হয়েছে, এখন উচিত নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা। যারা টেন্ডারে অংশ নিয়েছিলেন, তারা ফের অংশ নেবেন। যোগ্যতা থাকলে দরপত্র পাবেন। তাতে করে সমালোচনা থাকবে না। না হলে বুঝতে হবে এখানে একটি মহলের কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট আছে।"

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া দেননি।

নোভা

×