
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার ক্ষমতায় এসে শুল্কহার নিয়ে সমগ্র বিশ্বে এক ধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরু করেছেন। যাকে অর্থনীতির ভাষায় উচ্চ শুল্কহারের ‘অস্ত্র’ বলা হয়। সেই যুদ্ধ যেন থামছেই না। অবশ্য ক্ষমতায় আসার আগেই নির্বাচনী প্রচারে জোরেশোরে বলে এসেছেন আমেরিকার সঙ্গে যেসব দেশের বাণিজ্য ঘটতি আছে, সেসব দেশের বিরুদ্ধে উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করার কথা। আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের বিরুদ্ধেই যে উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করবেন তেমন আভাসই মিলছিল ট্রাম্পের সেই নির্বাচনী প্রচারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল বিশ্বের সব দেশই আজ ট্রাম্পের উচ্চশুল্ক হারের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, যা আমাদের দেশের জন্য একটি কঠিন অর্থনৈতিক আঘাত। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য, যা দেশের প্রধান রপ্তানি খাত। আগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের গড় শুল্কহার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ, তা এখন দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, এই ব্যাপক হারে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের মূল প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা আমাদের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি বাজার। উল্লেখ্য, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর চড়া হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে। এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে সম্পূরক শুল্ক পুনর্বিবেচনা করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি পাঠান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হয় সেখানে। এই তিন মাস সময় ট্রাম্প মূলত দিয়েছিলেন আলোচনার জন্য। বাংলাদেশের তরফ থেকেও সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে কার্যত তেমন কোন কাজ হয়নি। ৩৭ শতাংশের বদলে ট্রাম্প এবার ৩৫ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করেছেন বাংলাদেশের ওপর। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি বলেই ধারণা করা যায়। একটি ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তিতে পৌঁছতে না পারা শুধু একটি কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়, তা বৈশ্বিক বাণিজ্য রাজনীতির পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় বাংলাদেশের ঝুঁকিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা এমন এক সময়- যখন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং বাণিজ্য প্রটেকশনিজম বাড়ছে, তখন বাংলাদেশ যদি সময়োপযোগী ও কৌশলগত কূটনীতিতে পিছিয়ে পড়ে, তাহলে এর দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিণতি হতে পারে আরও ভয়াবহ। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশের সামনে এখন সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশ এখনো সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য নব্বই দিন পার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমেরিকার যে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য সমঝোতা হয়েছে- এমন দাবি করার সুযোগ নেই। জানা গেছে, এ পর্যন্ত তিনটি দেশ অর্থাৎ যুক্তরাজ্য, চীন এবং ভিয়েতনাম আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য সমঝোতা করতে পেরেছে। যুক্তরাজ্য বাণিজ্যিকভাবে কতটা সমঝোতায় উপনীত হতে পেরেছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অনেকের ধারণা যুক্তরাজ্য আমেরিকার সঙ্গে দীর্ঘদিনের নিবিড় সম্পর্কের প্রভাবের কারণে তাদের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্কহার হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে। তবে চীনের ব্যাপারটি একেবারেই ভিন্ন। চীনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য সমঝোতা হয়েছে- এমন দাবি করার সুযোগ নেই। বরং বলা যেতে পারে, চীনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধবিরতি (ট্রেড ওয়ার ট্রুস) কার্যকর হয়েছে। আমেরিকার উচ্চশুল্ক আরোপের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীনও আমেরিকার বিরুদ্ধে উচ্চহারে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেহেতু দুটো দেশই বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনীতির দেশ, তাই তারা এই বাণিজ্য যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। সেই বিবেচনায় ভিয়েতনাম একমাত্র দেশ, যারা আমেরিকার সঙ্গে একটি বাণিজ্য সমঝোতা বা ট্রেড ডিলে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে।
এ দিকে বাংলাদেশ আমেরিকার সঙ্গে শুল্কহার লাঘবের উদ্দেশ্যে বাণিজ্য সমঝোতা বা ট্রেড ডিল করার ব্যাপারে কতটুকু এগিয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় পণ্য রপ্তানির ওপর পূর্বের ঘোষিত শুল্ক হার ৩৭ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। এটি মূলত শুল্কহার হ্রাস বা বাণিজ্য সমঝোতার পর্যায়ে পড়ে না। বাংলাদেশের ওপর শুল্কহার হ্রাস করার অনুরোধ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ট্রাম্পের কাছে যে পত্র দিয়েছিলেন তার প্রতি এক ধরনের নামমাত্র সম্মান জানানো ছাড়া আর কিছুই নয় বলে আমরা মনে করি।
আসলে শুল্ক আরোপ শুধু দামের ওপর নয়, দেশের মোট উৎপাদনেও (জিডিপি) নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২০২০ সালে ১৫১টি দেশের ১৯৬৩-২০১৪ কালপর্বের তথ্য বিশ্লেষণ করে এক গবেষণায় দেখা যায়, এ শুল্ক দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে যায়। শুল্ক কম থাকলে যেসব পণ্যে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা আছে, দেশগুলো সাধারণত সেসব পণ্য উৎপাদনে জোর দেয়। কিন্তু শুল্ক বাড়লে শ্রমশক্তি ততটা দক্ষভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। শুল্কনীতির আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো, এতে অনিশ্চয়তা বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যৎ করনীতির ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন না। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইনডিপেনডেন্ট বিজনেসের এক জরিপে দেখা গেছে, অনিশ্চয়তার ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলোর পুঁজি বিনিয়োগ পরিকল্পনা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। আরও অবাক করা বিষয় হলো, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শুল্ক আরোপে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পরিবর্তে বেকারত্ব কিছুটা বাড়ে। ডার্টমাউথের ডগ আরউইনের মতে, ২০১৮ সালের ইস্পাত শুল্কে কর্মসংস্থান কমে গেছে। কারণ স্টিলশিল্পে যেসংখ্যক লোক কাজ করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ কাজ করেন স্টিলনির্ভর বিভিন্ন খাতে। ২০১৮-১৯ সালের যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডের এক গবেষণায় দেখা যায়, এতে উৎপাদন খরচ বাড়ে, কর্মসংস্থান কমে। কার্যত প্রতিশোধমূলক শুল্কের কারণে ক্ষতি বৃদ্ধি হয়।
এ কথা সত্য যে, ট্রাম্পের উচ্চশুল্কের প্রভাবে বিশ্বের অনেক দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বাদ যাবে না আমাদের দেশও। বরং আমাদের দেশ যে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ আমাদের রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ খুবই সীমিত। তৈরি পোশাক হচ্ছে একমাত্র উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য। এই তৈরি পোশাকের সিংহভাগ রপ্তানি হয় আমেরিকার বাজারে। এই উচ্চশুল্ক হারের কারণে আমেরিকার বাজারে পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। আকস্মিক এই মূল্যবৃদ্ধিতে একদিকে যেমন আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা হ্রাস পাবে, অন্যদিকে তেমনি আমেরিকার ব্যবসায়ীরা বিকল্প রপ্তানি দেশ খুঁজে নেবে। ফলে সমগ্র তৈরি পোশাক খাত এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে। আর তেমনটা হলে, দেশের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি তো হবেই, সেই সঙ্গে দেখা দিবে সামাজিক অস্থিরতা। এর প্রভাব পড়বে সারাদেশে ও সব সেক্টরে। কারণ তৈরি পোশাক খাতে সরাসরি নিয়োজিত আছে ৫০ লক্ষাধিক শ্রমিক, যাদের অধিকাংশই আবার নারী। আর সারাদেশে এই পেশাকেন্দ্রিক প্রায় দেড় কোটি মানুষের জীবনজীবিকা। এই শ্রমিক জনগোষ্ঠী যদি কোনো কারণে বেকার হয়ে যায়, তখন তার প্রভাব হবে ভয়াবহ। কেননা বেকার থাকা, আর কর্মক্ষম অবস্থা থেকে বেকার হয়ে যাওয়া আরও ভয়ানক।
এমনিতেই আমাদের গার্মেন্টস শিল্প এখন অনেক ক্ষতির সম্মুখীন। বহু কারখানা বন্ধ হয়েছে এবং কিছু কারখানায় আন্দোলন, সংগ্রাম এবং সরকার পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। গার্মেন্টস মালিকরা আছেন চরম অনিশ্চয়তায়। এমনিতেই তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশ সংগ্রহ করতে হয় কমপক্ষে ছয় মাস আগে। শীতের পোশাক রপ্তানির আদেশ সংগ্রহ করা হয় গ্রীষ্মকালে, আর গরমের পোশাক রপ্তানির আদেশ সংগ্রহ করতে হয় শীতকালে। তাই অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতা থাকলে এ ধরনের রপ্তানি আদেশ পেতে যে সমস্যা হবে এটাই বাস্তবতা। আর নানা অস্থিরতার কারণে আমেরিকার আমদানিকারকদের সঙ্গে আলোচনা এবং রপ্তানি আদেশ সংগ্রহ করতে পারছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।
যেভাবেই হোক দেশের এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। রপ্তানি খাতকে রক্ষা করতে হবে। শুল্কহার কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য আলোচনাই একমাত্র পথ। আমরা মনে করি, সাধারণ আলোচনা বা কূটনৈতিক যোগাযোগ বা চিঠি লেখার মাধ্যমে এই শুল্ক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সবার আগে প্রয়োজন দেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। সবচেয়ে ভালো হয় সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে সরাসরি নিয়োজিত করতে পারলে। আলোচনার সুযোগ এখনো আছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য সমঝোতা বা ট্রেড ডিল সম্পন্ন করা প্রয়োজন, যার অধীনে শুল্কহার হ্রাস করা যায়। মূল কথা হচ্ছে, দেশের স্বার্থেই এই উচ্চশুল্ক সমস্যার সমাধান করা অতীব জরুরি।
লেখক : কলামিস্ট ও শিল্প-উদ্যোক্তা
প্যানেল/মো.