
এনবিআর নামের প্রতি মানুষের একটি নেগেটিভ ধারণা রয়েছে জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, এ কারণে এই নামটি আর থাকবে না। রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব বাস্তবায়ন নামে দুটো বিভাগ যেটা হয়েছে, এখন থেকে সেটাই থাকবে। দুই বিভাগের জন্য দুজন সচিব থাকবেন। গত ১৩ জুলাই সচিবালয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, এনবিআর সংস্কার নিয়ে যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, সেখানে কিছু সমস্যা রয়েছে। শব্দ গঠনেও ছিল কিছু ভুল। উপদেষ্টা কমিটি সেগুলো সংশোধনের সুপারিশ করবে। এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এক পর্যায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করেছিল। দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করা ও রাজস্ব আদায় বাধাগ্রস্ত করাই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল।
এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন আর কাজ না করার ফলে রাজস্ব ফাঁকি বেড়েছে, সেই সঙ্গে গত অর্থবছরে সর্বাধিক পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। রাজস্ব ফাঁকি সম্পর্কে এনবিআর সূত্রে জানা যায়, রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনে গত ৯ মাসে (সেপ্টেম্বর-মে) মোট ১৬ হাজার ৫৭২টি অভিযান পরিচালনা করেছে এনবিআরের আয়কর ও কাস্টমস বিভাগের বিভিন্ন দপ্তর। আর এসব অভিযানে ৬ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। যার বিপরীতে ৯৯৪ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে বলে জানা গেছে। জাতীয় রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর মাঠ পর্যায়ের দপ্তর এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটন অভিযান থেকে ৯ মাসে এনবিআরের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯৯৪ কোটি টাকা। এনবিআরের এমন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত নয় মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কাস্টমস ও আয়করের মাঠ পর্যায়ের দপ্তর এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মোট ১৬ হাজার ৫৭২টি রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করেছে। এতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা এবং আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ ৯৯৪ কোটি টাকা। ওই সময়ে বিভিন্ন কাস্টম হাউস মোট ২ হাজার ২১৫টি রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করেছে। যাতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১৮৩ কোটি টাকা, যার পুরোটাই আদায় হয়েছে। বিভিন্ন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট মোট ৬ হাজার ৮০৩টি রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করেছে যাতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৫১৩ কোটি এবং আদায় হয়েছে মোট ৮৯ কোটি টাকা।
আর ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ২৩১টি রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করেছে। এতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা এবং আদায় হয়েছে মোট ২৪০ কোটি টাকা। এছাড়া কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এ সময়ে রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করে মোট ৭৩ কোটি টাকা আদায় করেছে।
অপরদিকে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) ১৮১টি কর ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করেছে। এতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৩৬৬ কোটি টাকা এবং আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ ১৯৪ কোটি টাকা। আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট মোট ১৭০টি কর ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করেছে। এতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা এবং আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ ১১০ কোটি টাকা। এছাড়া বিভিন্ন কর অঞ্চল (৪১টি) মোট ৬ হাজার ৯৭২টি কর ফাঁকি উদঘাটনের অভিযান পরিচালনা করেছে। এতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা এবং আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ ১০৫ কোটি টাকা।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের অপসারণ ও সব পক্ষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে রাজস্ব খাতের সংস্কার দাবিতে কর্মকর্তাদের আন্দোলনে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়াল ঠেকে গেছে জানিয়ে দ্রুত এই সংকট নিরসনে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ দাবি জানিয়েছে শীর্ষ ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারক সংগঠনগুলো। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এ অর্থবছরে ৪.৬৩ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতে মূল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪.৮০ লাখ কোটি টাকা। জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীরগতি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন কমে যাওয়া এবং অর্থবছর শেষে এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলন ও কর্মবিরতি কর্মসূচির কারণে এ ঘাটতি হয়েছে। বড় অঙ্কের এই রাজস্ব ঘাটতির অন্যতম কারণ হলো মাত্রাতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ। অবশ্য জুলাই অভ্যুত্থানের কারণে রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও তা এতটা কমে যাওয়ার কথা ছিল না।
এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, তারা এখনো পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাননি। ‘আমরা আশা করছি, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রাজস্ব আদায় ৩.৭০ লাখ কোটি টাকা হবে। কিন্তু ৩.৮০ লাখ কোটি টাকা আদায় হওয়ার কথা ছিল। তবে ৩.৭০ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় ধরলেও প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি দাঁড়ায় প্রায় ১.১০ লাখ কোটি টাকা। আর কমিয়ে আনা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ ঘাটতি প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত দুই দশকে কোভিড-আক্রান্ত বছর ছাড়া এত কম প্রবৃদ্ধি আর কখনই হয়নি। মহামারির প্রেক্ষাপটে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। গত কয়েকদিনে কর্মকর্তাদের আন্দোলনকে ইঙ্গিত করে প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় হয়নি উল্লেখ করে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘গত কয়েক দিনে রাজস্ব আদায় হোঁচট খেয়েছে।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে চলতি মূল্যে জিডিপির আকার হবে ১০ শতাংশের বেশি। ‘তাহলে রাজস্ব আদায়েও প্রবৃদ্ধি এই হারে হওয়ার কথা। কিন্তু প্রবৃদ্ধি হবে ২ শতাংশের মতো। তার অর্থ হলো যতটুকু রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা, তা হয়নি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৪৯ শতাংশ, যা গত দেড় দশকে সর্বনিম্ন। কম রাজস্ব আদায় এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়ার জন্য দায়ী, আবার কম এডিপির কারণে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। কেননা এডিপি বাস্তবায়ন হলে সেখান থেকে সরকার উৎসে কর ও ভ্যাট আকারে রাজস্ব আদায় করে। তবে এনবিআর বিলুপ্ত করা সংক্রান্ত অধ্যাদেশের পর কর্মকর্তাদের দাবির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চললে রাজস্ব আদায়ে এত নেতিবাচক প্রভাব পড়ত না।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে কম প্রবৃদ্ধি হওয়ায় নতুন অর্থবছরের জন্য এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ হয়ে গেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সরকার রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ৪.৯৯ লাখ কোটি টাকা। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাও কঠিন হতে পারে। যাই হউক, আমি মনে করি এনবিআর সংস্কারের যে পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেছেন, তা বাস্তবায়ন করাই হবে উত্তম কাজ। কারণ এভাবে রাজস্ব ঘাটতি চলতে পারে না। রাজস্ব ঘাটতির ফলে সরকারের কাঁধে পাহাড় পরিমাণ দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা চাপছে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন
প্যানেল/মো.