ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২

চলন্ত ট্রেনের মতো জীবন, তুমি উঠবে না দাঁড়িয়ে থাকবে?

মেহেদী হাসান

প্রকাশিত: ০০:২১, ২৪ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০১:১৩, ২৪ জুলাই ২০২৫

চলন্ত ট্রেনের মতো জীবন, তুমি উঠবে না দাঁড়িয়ে থাকবে?

জীবনটা যেন হঠাৎ করে ছুটে চলা এক ট্রেন, জায়গামতো দাঁড়ায়, আবার মুহূর্তেই চলে যায়। কোন স্টেশনে নামবো, কোনটায় উঠবো, সে সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তগুলো সবসময় সহজ হয় না। আমাদের সামনে প্রতিদিন নতুন নতুন দরজা খুলে যায়, একটা নতুন সুযোগ, একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, একটা ডাক, যা সাড়া চায়। কেউ দাঁড়িয়ে থাকে, চিন্তায় ডুবে যায়, কেউ আবার ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে ওঠে সেই ট্রেনে। এই ট্রেন কখনো তোমার স্বপ্নকে কাছে টানে, কখনো সেটা শুধু হুইসেল বাজিয়ে চলে যায়। এই জীবনের ট্রেন সবসময় সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করে না, তুমি প্রস্তুত কি না, সেটাও জিজ্ঞেস করে না।

যদি তুমি সঠিক মুহূর্তে সাহস করে উঠতে পারো, তবে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। আর যদি দাঁড়িয়ে থাকো, তখন হারিয়ে যায় শুধু সময় নয়, চলে যায় তোমার সম্ভাবনা, তোমার অপ্রকাশিত গল্প। অলি অ্যান্ডারসনের "দ্য ট্রেন: এ মেটাফর ফর দ্য গুড লাইফ অ্যান্ড গ্রোয়িং রিয়েল" এই লেখায় ট্রেনের দিকে এগিয়ে যাওয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে "উদ্দেশ্যের" দিকে অগ্রসর হওয়া, স্টেশনে আটকে থাকা বা ভুল পথে থাকা সব মিলিয়ে একটি জীবন দর্শন।

জীবন কখনো থেমে থাকে না। জীবন এক প্রবাহমান ধারা, এক উচ্ছ্বসিত স্রোতের মতো, যা কারও আবেগ, ব্যথা বা দ্বিধার জন্য থেমে থাকে না। তুমি যখন দুঃখে ভাঙচুর হও, ব্যর্থতায় জর্জরিত হও, অথবা সিদ্ধান্তহীনতার কুয়াশায় হারিয়ে যাও, তখনও সময় নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। সে জীবন, কোনো দিনের জন্য বিশ্রাম চায় না, তার গতির সুর অটল, নিরবচ্ছিন্ন। এই বাক্যটি কেবল একটি ভাবনা নয়, এটি আমাদের বাস্তবতা। জীবন যেখানে ছুটছে নিরন্তর, সেখানে থেমে যাওয়া মানেই পিছিয়ে পড়া, কারণ তুমি যত দেরি করো, সুযোগ তত দুর্লভ হয়ে ওঠে। সেই ট্রেন, যেটি তোমার স্বপ্নের গন্তব্যে যাবে, সবসময় অপেক্ষা করবে না।

ভয়ই কি আমাদের আটকে রাখে? আমরা চাই একটা সফল জীবন, স্বপ্নপূরণের আনন্দ, গভীর ভালোবাসা, আর নিঃস্বার্থ সম্মান। কিন্তু চাওয়ার পরেও আমরা অনেকেই থেমে যাই। আমরা এগোই না, প্রথম ধাপটা নিই না। প্রশ্ন জাগে কেন? কারণ, 'ভয়'। ভয় যদি ব্যর্থ হয়ে যাই, ভয় যদি সবাই আমার সাহসকে উপহাস করে, ভয় যদি শুরু করি, কিন্তু শেষ করতে না পারি, এই ভয়গুলো স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে আসে না, কিন্তু ভেতরে এক অদৃশ্য প্রাচীর গড়ে তোলে যা বাধা দেয় আমাদের স্বপ্নের পথে হাঁটার সাহসকে। ভয়ের কণ্ঠ খুব নরম হয়, কিন্তু তার প্রভাব প্রচণ্ড। সে মনে করিয়ে দেয় আমাদের অতীত ভুলগুলো, সে তোলার চেষ্টা করে অসম্পূর্ণতার ছায়া, আর চুপিচুপি প্রশ্ন করে, “তুই কি পারবি?” কিন্তু সত্যি কথা হলো, "সফলতা কখনোই ভয়ের অনুপস্থিতিতে আসে না।" সফলতা আসে সেই মুহূর্তে, যখন আমরা ভয় থাকা সত্ত্বেও সামনে এগিয়ে যাই।

চলন্ত ট্রেনে ওঠার মানে কী? জীবনে অনেক সময় এমন মুহূর্ত আসে, যখন আমাদের সামনে একটা সুযোগ আসে,কিন্তু সেই সুযোগটা নিতে গেলে ঝুঁকি নিতে হয়। হয়তো চাকরি ছেড়ে নিজের কিছু শুরু করা; পরিবার বা সমাজের চিন্তা না করে নিজের স্বপ্নে এগোনো, বা নিজের ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে আসা। অনেকেই বলে “আরে, আমি পরে শুরু করবো”, “ভালো করে শিখে তারপর করবো” কিন্তু সেই ‘পরে’ অনেক সময় আসেই না। ট্রেন চলতে চলতে তুমি পিছিয়ে পড়ো, আর যারা উঠেছিল, তারা আজ অনেকদূরে। তাই নিজের দক্ষতা বা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া মানেই চলন্ত ট্রেনে উঠে পড়া। সব সময় বড় সুযোগ আসবে না। অনেক সময় জীবনের গতি বদলায় একটা ছোট সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা ছোট কাজের অফার; একদিনের কোনো ইভেন্ট। কেউ হয়তো বলে, “এটা তেমন কিছু না”, কিন্তু তুমি যদি সেটার মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পাও আর সাহস করে নাও, তবে সেখান থেকেই শুরু হয় তোমার যাত্রা।

দাঁড়িয়ে থাকলে কী হয়? সময় চলে যায়, তুমি থেকে যাও। জীবনের গতি কখনো থামে না। তুমি চাইলেও সে থামবে না। তখন সময় এগিয়ে যাবে, অন্যরা এগিয়ে যাবে, তুমি শুধু পেছনে পড়ে থাকবে। সময় কাউকে অপেক্ষা করে না। তুমি দাঁড়িয়ে থাকলে, জীবন তোমাকে পিছনে ফেলে যাবে। দ্বিধা আর ভয় তোমাকে গিলে ফেলে। যখন তুমি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছো না, তখন ভয়, অনিশ্চয়তা, হতাশা ধীরে ধীরে মনের ভেতর জমতে থাকে। তুমি তখন কেবল ‘যদি’, ‘কিন্তু’, আর ‘হয়তো’ এই শব্দগুলো নিয়ে বাঁচতে থাকো। “যদি আমি করতাম…” এই আফসোসটাই দাঁড়িয়ে থাকার সবচেয়ে বড় ফল। সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়, ট্রেন সবসময় থেমে থাকে না। ঠিক সময়ে সাহস না করলে সেই সুযোগগুলো চলে যায় অনেক সময় চিরতরে। নিজেকে ছোট ভাবতে শুরু করো। চেষ্টা না করলে কখনো জানা যায় না তুমি কী করতে পারো। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলে তুমি নিজেই ভাবতে শুরু করো, “আমি পারবো না…”, “আমি দেরি করে ফেলেছি…”, “আমি সাধারণ একজন…”। এই মানসিকতা তোমার স্বপ্ন, আত্মবিশ্বাস, ও জীবনের রঙকে একে একে মুছে ফেলে।

বাস্তব উদাহরণ হিসেবে মালালা ইউসুফজাইকে দেখা যায়, যিনি সুযোগ আসার আগেই সাহস দেখিয়েছিলেন। পাকিস্তানে তালেবান শাসনে যখন মেয়েরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করছিল, তখন মাত্র ১১ বছর বয়সে মালালা সাহস করে বিবিসিতে ডায়েরি লিখতে শুরু করেন। বাকি অনেক মেয়েও একই পরিস্থিতিতে ছিল, কিন্তু তারা চুপ ছিল ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ফলাফল: মালালার লেখাগুলো বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে দেয়, আজ সে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত, আর যারা চুপ ছিল, তাদের গল্প কেউ জানে না। শিক্ষা হলো: চুপ করে থাকলে, ভয় পেলে, “সময় হলে করব” বললে কেউ তোমাকে জানবে না। সাহস দেখালে, সুযোগ নিজেই আসবে।

-লেখকঃ মেহেদী হাসান, শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।

×