ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২

নির্জীব থেকে ফিরে পায় প্রাণ: গ্রীষ্মকালে ‘জম্বি গাছ’ হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষকদের ভরসা

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৫ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০৫:২৮, ২৫ জুলাই ২০২৫

নির্জীব থেকে ফিরে পায় প্রাণ: গ্রীষ্মকালে ‘জম্বি গাছ’ হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষকদের ভরসা

ছবি: সংগৃহীত

উষ্ণায়নের কারণে বাড়তে থাকা খরার হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করতে বিজ্ঞানীরা তাকিয়েছেন এক অনন্য গাছপালার জিনের দিকে, যারা মাসের পর মাস পানি ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আবার সবুজ হয়ে উঠতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৭০-এর দশকে শিশুকাল কাটানোর সময় প্রফেসর জিল ফ্যারান্টের প্রথম নজরে আসে এই অদ্ভুত গাছগুলো, যারা মৃতপ্রায় হয়ে যাওয়ার পর আবার জীবন ফিরে পায়। প্রফেসর জিল ফ্যারান্ট জানান, এই গাছগুলো ছয় মাস বা তারও বেশি সময় পানি ছাড়াই বাঁচতে পারে। পাতা ধূসর ও ভঙ্গুর হয়ে গেলেও পানি পেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা সবুজ হয়ে ওঠে এবং একদিনের মধ্যে আগের মতো ছবি ফিরে পেয়ে সূর্যের আলো থেকে খাদ্যসংশ্লেষণ শুরু করে।

সাধারণত মস, ফার্ন ও অন্যান্য অফুল-ফুলে গাছের মাঝে এই রকম ‘লাজরাস ক্ষমতা দেখা যায়, কিন্তু এই রিজারেকশন প্ল্যান্টস মূলত ফুল ফোটানো গাছ (অ্যাঞ্জিওস্পার্মস) শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে রয়েছে ফলসহ গাছ ও বীজ বহনকারী ফসল। মোট ৩৫২,০০০ প্রজাতির ফুল ফোটানো গাছের মধ্যে মাত্র ২৪০ প্রজাতি এই রিজারেকশন গাছ। দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার পাথুরে ঢালুতে বা বালি জমিতে ছড়িয়ে থাকা এদের মধ্যে অধিকাংশই একে অপরের সাথে সম্পর্কহীন, তবে সকলেই স্বাধীনভাবে পানি ছাড়া বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেছে। এদের ডিএনএর গভীর থেকে এক রকম পুরানো টুলকিট বেরিয়ে এসেছে যা শুষ্কতার মতো কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করে।

কেপ টাউনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেসিকেশন টলারেন্স বিভাগের অধ্যাপক জিল ফ্যারান্ট এবং তার সহকর্মীরা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই গাছ নিয়ে গবেষণা করছেন। তাদের বিশ্বাস, এদের জিনে থাকা এই শুষ্কতা সহনীয় ক্ষমতা জলবায়ু পরিবর্তনের সময় কৃষিকে অভিযোজিত করার চাবিকাঠি হতে পারে।

এক গাছের মাসের পর মাস পানি ছাড়া বেঁচে থাকা শোনাতে যতটা অবাস্তব মনে হয়, বাস্তবে অধিকাংশ গাছ মাত্র ১০-৩০% পানি হারালে মরতে শুরু করে। কিন্তু রিজারেকশন প্ল্যান্টস ৯৫% এর বেশি পানি হারানোর পরেও বেঁচে থাকতে পারে।

ফ্লোরিডার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুট্টা বিজ্ঞানী কার্লোস মেসিনা বলেন, শুধু শুষ্কতা সহ্য করার ক্ষমতা নয়, বরং এই গাছগুলো শুষ্কতার পর কিভাবে পুনরুজ্জীবিত হয় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানান, ভুট্টা শুষ্কতা থেকে বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু পানি ফিরে পাওয়ার পর আগের পাতার গঠন ফিরিয়ে আনতে পারে না, ফলে ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়া ও পানি প্রবাহ ব্যাহত হয়। আর রিজারেকশন গাছ আবার আগের স্বরূপে ফিরে আসে। যদি ভুট্টাকেও এমন করা যায়, তবে তা কৃষির জন্য বড় পরিবর্তন আনবে।

রিজারেকশন গাছগুলো পানি হারানোর সময় সুক্রোজের মতো চিনির মাধ্যমে তাদের কোষের ভেতর এক ধরনের কাঁচের মতো ঘন ও আঠালো পদার্থ তৈরি করে, যা রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ভিট্রিফিকেশন’। একই কৌশল ব্যবহৃত হয় টার্ডিগ্রেড (ওয়াটার বেয়ার) ও আর্তেমিয়া প্রজাতির সামুদ্রিক ছোট প্রাণীর ডিমের মধ্যেও।

গাছগুলো কাঁচে পরিণত হওয়ার সময় তাদের খাদ্যের প্রধান উৎস ক্লোরোপ্লাস্ট ভেঙে ফেলে এবং বিশেষ ধরনের প্রোটিন ‘চাপেরোন’ সেক্রেট করে যা কোষের সুরক্ষা দেয়। জিল ফ্যারান্ট বলেন, ‘তারা তাদের টিস্যু এতো সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে, এটা সত্যিই এক অবাক করা ঘটনা।’

রিজারেকশন গাছের এই ক্ষমতা অনেকটাই বীজের মতো, যেগুলো শুকিয়ে গাঢ় ও ঠান্ডা স্থানে সযত্নে সংরক্ষণ করলে অনেক বছর বাঁচতে পারে। কিন্তু বীজ থেকে যখন প্রথম শাখা গজায়, তখন ‘শুষ্কতা সহনীয়তা’ হারিয়ে যায়, পরিবর্তে গাছ দ্রুত বেড়ে ফল ও বীজ উৎপাদনে মনোনিবেশ করে।

বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে শুষ্কতা, অগ্নিকাণ্ড ও তাপপ্রবাহ আরও তীব্র হচ্ছে। ২০২৩ সালে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এসব কারণে ফসলের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৬.৬ বিলিয়ন ডলার। জলবায়ু মডেল অনুযায়ী, ২১০০ সালের মধ্যে সাব-সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ কৃষি জমি অযোগ্য হয়ে পড়বে। নেদারল্যান্ডসের অবসরপ্রাপ্ত বীজ বিজ্ঞানী হেঙ্ক হিলহরস্ট বলেন, ‘অর্থাৎ বিশ্বকে এখন কানাডা ও সাইবেরিয়ার মতো ঠান্ডা অঞ্চলের ওপর নির্ভর করতে হবে।’

ফ্যারান্ট বলেন, ‘খাদ্যের অভাব হবে, তাই আমাদের অত্যন্ত সৃজনশীল হতে হবে।’

গম, ভুট্টা, সয়াবিনসহ সাধারণ ফসলগুলো ইতোমধ্যেই নির্বাচন প্রজননের মাধ্যমে পানির অভাবে আরও টেকসই করা হয়েছে। তবে আজকের জলবায়ুর পরিবর্তনে ঝড়, শুষ্কতা এখন আগের থেকে আরও অনিয়মিত ও হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটি সমস্যা।

এজন্য বিজ্ঞানীরা রিজারেকশন গাছের ডিএনএর মধ্যে থাকা ক্ষমতাকে চালু করে সাধারণ ফসলগুলোকে শুষ্কতার বিরুদ্ধে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি জিন-সম্পাদনা প্রযুক্তি ‘ক্রিস্পার’ ব্যবহার করে করা হচ্ছে।

তবে ফ্যারান্টের সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, বীজের মধ্যে যেসব জিন থাকে, সেগুলোকেই সক্রিয় করলে গাছ শুষ্কতার বিরুদ্ধে আরও টেকসই হতে পারে, যার জন্য নতুন জিন প্রবেশ করানোর প্রয়োজন নেই। এ প্রযুক্তি কম বিতর্কিত হতে পারে।

ফরাসি জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বীজ বিজ্ঞানী জুলিয়া বুইটিঙ্ক বলছেন, শুরুর দিকে তরুণ চারা পর্যায়েই শুষ্কতা সহনীয়তা বাড়ানো যেতে পারে, যা গাছের জন্য সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত।

তবে কীভাবে এই জিনগুলো শুষ্কতা বা সংকটে সক্রিয় হবে সে ব্যাপারে এখনও অনেক জটিলতা রয়েছে। এছাড়া এই জিনগুলো চালু করলে গাছের অন্যান্য গুণাবলীতে প্রভাব পড়তে পারে এবং ফলনের পরিমাণ কমে যেতে পারে।

কিন্তু যদি এমন ‘মাস্টার সুইচ’ পাওয়া যায় যা শুধুমাত্র শুষ্ককালে সক্রিয় হয়, তাহলে গাছের ফলন ঠিক থাকবে। যেমন রিজারেকশন গাছ শুধু খরার সময় শুকিয়ে যায়, ফসলও কেবল ঝটকা শুষ্ককালে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।

২০১৮ সালে কেনিয়া ও সুইডেনে গবেষকরা রিজারেকশন প্ল্যান্ট ‘জেরোফাইটা ভিসকোসা’ থেকে এক জিন (XvAld1) সুইট পটেটোতে প্রবেশ করিয়ে ১২ দিনের শুষ্কতা পরীক্ষায় গাছগুলোকে সবুজ ও সুস্থ রাখতে সক্ষম হন।

এছাড়া আরবিডোপসিস ও তামাক গাছেও রিজারেকশন গাছের জিন ব্যবহার করে শুষ্কতা সহনীয়তা বৃদ্ধি পাওয়া গেছে। তবে জিএম ফসলের নিয়মিত কঠোর পরীক্ষার জন্য এখনও এই গবেষণা চলছে।

মানুষের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যেমন মাইক্রোবায়োম আলোচিত হচ্ছে, তেমনি কৃষিতেও গাছের মূল বা শিকড়ের মাইক্রোবায়োম (রাইজোস্ফিয়ার) গুরুত্ব পাচ্ছে। শুষ্কতা সহনীয়তা হয়তো শুধু পাতায় নয়, শিকড়ের মধ্যেও লুকিয়ে আছে। কেপ টাউনের গবেষকরা Myrothamnus flabellifolia নামের একটি রিজারেকশন প্ল্যান্টের মাইক্রোবায়োম গবেষণা শুরু করেছেন, যা দক্ষিণ আফ্রিকার পাথুরে মাটিতে কোমর সমান উচ্চতা পর্যন্ত বেড়ে ওঠে এবং ৯ মাসেরও বেশি সময় পানি ছাড়া বাঁচতে পারে।

তাদের গবেষণায় ৯০০ এর বেশি ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস শনাক্ত হয়েছে, যা ভবিষ্যতে শুষ্কতা সহনীয় ‘প্রোবায়োটিক’ হিসেবে ব্যবহার হতে পারে।

ফ্যারান্টের সবচেয়ে আশাপ্রদ কাজ হল ইথিওপিয়ার জনপ্রিয় গ্লুটেন-মুক্ত শস্য তেফ নিয়ে গবেষণা। তেফের কাছাকাছি সম্পর্কিত রিজারেকশন প্ল্যান্ট ‘এরাগ্রোস্টিস নিংডেনসিস’ এর সাহায্যে তারা দেখতে চান কোন কোন জিন হারিয়ে গেছে বা নিষ্ক্রিয় হয়েছে, যা পুনরায় প্রবেশ করালে শুষ্কতা সহনীয়তা বাড়বে।

শুষ্কতায় অতিবেগুনী রশ্মি থেকে সুরক্ষার জন্য লিফে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যানথোসায়ানিন তৈরি করে, যা সূর্যের ক্রিমের মতো কাজ করে, কিন্তু তেফের মধ্যে এটি নেই। এই বৈশিষ্ট্য থাকলে তেফ কঠিন শুষ্কতায় বেঁচে থাকতে পারবে।

 

সূত্র: বিবিসি।

রাকিব

×