
ছবি: সংগৃহীত (বিবিসি)
মানবদেহে ক্রমেই প্রবেশ করছে বিপজ্জনক মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা নিয়ে এবার বিশ্বজুড়ে বাড়ছে উদ্বেগ। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু রক্ত বা ফুসফুস নয়, এমনকি মানুষের হাড়ের মধ্যেও মিলছে ক্ষুদ্র এই প্লাস্টিক কণা।
লন্ডনের হার্টফোর্ডশায়ারের রথামস্টেড রিসার্চ সেন্টারে সংরক্ষিত পৃথিবীর দীর্ঘতম কৃষি-আর্কাইভের মাটি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানান, ১৯৪০ ও ৫০-এর দশকের নমুনায় যেমন পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার রেডিওঅ্যাকটিভ কণা পাওয়া গেছে, তেমনি ১৯৬০-এর পর থেকেই সেখানে ধরা পড়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি।
বিশ্বজুড়ে এখন মানুষ ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক খাচ্ছে ও শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ১৯৯০ সালের তুলনায় এখন এই গ্রহণের হার ছয় গুণ বেশি।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, প্লাস্টিকজাত পণ্যে গরম পানি ঢালা, মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করাসহ বিভিন্ন উপায়ে এই প্লাস্টিক কণা আমাদের শরীরে ঢুকছে। ২০২৫ সালের শুরুর দিকে লন্ডনে এক পরীক্ষায় আটজন স্বেচ্ছাসেবককে মাইক্রোপ্লাস্টিকযুক্ত দ্রবণ পান করিয়ে শরীরের প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল এখনও প্রকাশ হয়নি, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটাই প্রথমবারের মতো প্লাস্টিক নিয়ে এ ধরনের ‘হিউম্যান চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল’।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষক স্টেফানি রাইট বলেন, “আমরা প্রতিদিনই নিজের অজান্তে শরীরে প্লাস্টিক ঢুকিয়ে চলেছি। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হলো গরম পানি বা গরম পরিবেশ, যেখানে প্লাস্টিক থেকে কণা সহজেই মুক্ত হয়ে যায়।”
গবেষণায় দেখা গেছে, এই মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে—যেমন লিভার, বৃক্ক, মস্তিষ্ক, এমনকি হাড়েও পৌঁছে যেতে পারে। সম্প্রতি মৃতদেহের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তি জীবদ্দশায় ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন, তাদের মস্তিষ্কে অন্যান্যদের তুলনায় ১০ গুণ বেশি প্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
২০২৪ সালে ইতালির এক গবেষণায় হৃদযন্ত্রে রক্ত সরবরাহকারী ক্যারোটিড ধমনীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক ধরা পড়ে, যা পরবর্তী তিন বছরে আক্রান্তদের স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৪.৫ গুণ বাড়িয়ে দেয়।
অপর গবেষক ম্যাথিউ ক্যাম্পেন বলেন, “প্লাস্টিক কণাগুলো মস্তিষ্কের উচ্চমাত্রার ফ্যাটের সঙ্গে মিশে স্নায়ুতন্ত্রে প্রবেশ করছে। ডিমেনশিয়ার ক্ষেত্রে রক্ত-মস্তিষ্ক বাধাও দুর্বল হয়ে যায়, ফলে প্লাস্টিক প্রবেশ সহজ হয়।”
তবে এখনো গবেষকরা সরাসরি দাবি করছেন না যে, মাইক্রোপ্লাস্টিকই এসব রোগের একমাত্র কারণ। বরং এটি অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে মিলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে।
পরিবেশ দূষণবিষয়ক গবেষক ফে কাউসেইরো বলেন, “এই প্লাস্টিকগুলো অ্যাসবেস্টসের মতো তাৎক্ষণিক ক্ষতি করে না, তবে ধীরে ধীরে কোষের ক্ষতি করে শরীরের ওপর বোঝা বাড়ায়।”
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, এক লিটার বোতলজাত পানিতে ২ লাখ ৪০ হাজার পর্যন্ত প্লাস্টিক কণা থাকতে পারে, যার ধরন ও আকার ভিন্ন। অনেক মাইক্রোপ্লাস্টিক আবার পরিবেশ দূষণকারী ভারী ধাতু ও টক্সিন নিজের মধ্যে শোষণ করে শরীরে নিয়ে আসে।
এছাড়া মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিনের বাহক হিসেবেও কাজ করে। কাউসেইরো বর্তমানে অ্যান্টার্কটিকায় এই বিষয়েই গবেষণা করছেন, যেখানে সমুদ্রের দূষিত পানি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ইতালির অধ্যাপক রাফায়েলে মারফেলা বলেন, এই ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বয়স বাড়ার গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এটি রক্তনালির ক্ষতি, দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ এবং কোষের ডিএনএ ধ্বংস করতে সক্ষম।
ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ভেরেনা পিচলার বলেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে টিউমার গঠনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তবে ক্যান্সার সৃষ্টিতে এর সরাসরি ভূমিকা এখনো নিশ্চিত নয়।
পরিস্থিতি যাই হোক, বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই প্রয়োজন সচেতনতা ও গবেষণা বাড়ানো। সম্ভব হলে এমন প্লাস্টিক উৎপাদন কমিয়ে আনা, যা সহজে শরীরে প্রবেশ করে রোগ তৈরি করতে পারে।
সূত্র: বিবিসি।
রাকিব