ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

 কিডনি নীরবে ধ্বংস হচ্ছে? জেনে নিন কীভাবে রক্ষা করবেন নিজেকে

প্রকাশিত: ১৪:৩৬, ২৬ জুলাই ২০২৫

 কিডনি নীরবে ধ্বংস হচ্ছে? জেনে নিন কীভাবে রক্ষা করবেন নিজেকে

ছবি: সংগৃহীত।

কিডনি- ছোট, বিন আকৃতির এই অঙ্গ দুটি আমাদের দেহে নীরবে কাজ করে চলে প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন অসংখ্যবার রক্ত ছেঁকে শরীর থেকে বর্জ্য, অতিরিক্ত পানি ও ইলেকট্রোলাইট বের করে দেয়। একইসঙ্গে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, লাল রক্তকণিকা উৎপাদনে সহায়তা এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু যখন এই কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন শরীরজুড়ে শুরু হয় নানামুখী জটিলতা।

কিডনি ক্ষতির প্রধান কারণ কী?
বিশ্বজুড়ে কিডনি রোগের সবচেয়ে বড় দুটি কারণ হলো ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন)। তবে এগুলোর বাইরেও রয়েছে আরও অনেক গোপন শত্রু, যা সময়ের সঙ্গে কিডনি ধ্বংস করতে পারে।

ডায়াবেটিস:
অনেকেই ভাবেন ডায়াবেটিস শুধু রক্তে চিনি বাড়ায়। কিন্তু এটি ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD)-এর সবচেয়ে সাধারণ কারণ। যখন দীর্ঘ সময় ধরে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকে, তখন কিডনির ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়—যেগুলো ফিল্টারের মতো কাজ করে। ধীরে ধীরে সেই ফিল্টারগুলো ‘জ্যাম’ হয়ে যায় বা ছিঁড়ে যায়, ফলে রক্তের প্রোটিন প্রস্রাবে চলে আসে—যা “প্রোটিনুরিয়া” নামে পরিচিত।

এই অবস্থায় কিডনি সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়, শরীরে বর্জ্য জমতে থাকে এবং রক্তচাপ আরও বেড়ে যায়। একে বলা হয় ডায়াবেটিক কিডনি ডিজিজ। যদিও ডায়াবেটিস থাকলেই কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, কিন্তু প্রায় ৪০% ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে এটি ঘটে যদি রক্তে চিনির নিয়ন্ত্রণ না থাকে।

উচ্চ রক্তচাপ:
নীরব ঘাতক নামে পরিচিত হাইপারটেনশন কিডনি ধ্বংসের দ্বিতীয় প্রধান কারণ। সাধারণত কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, কিন্তু যখন রক্তনালিতে চাপ বেশি থাকে, তখন কিডনির সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এটি অনেকটা একটি বাগানে পানির পাইপকে প্রতিদিন জোরে চালানোর মতো—অভ্যন্তরীণ আবরণ ক্ষয়ে যেতে থাকে। ফলাফল? কিডনি সঠিকভাবে বর্জ্য ও পানি বের করতে পারে না, অতিরিক্ত তরল শরীরে জমে গিয়ে আরও রক্তচাপ বাড়ায়। ধাপে ধাপে এটি ক্রনিক কিডনি ডিজিজ কিংবা কিডনি ফেইলিউরে রূপ নেয়।

অন্যান্য কারণ যেগুলো কিডনি ক্ষতির জন্য দায়ী:
গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস: কিডনির ফিল্টার ইউনিট (গ্লোমেরুলি) আক্রান্ত হয়ে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এর পেছনে সংক্রমণ বা অটোইমিউন রোগ দায়ী হতে পারে।

পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ: জিনগত একটি রোগ যেখানে কিডনিতে তরলভর্তি সিস্ট গড়ে ওঠে এবং স্বাস্থ্যকর অংশগুলো চেপে ধরে।

পুনঃপুন সংক্রমণ: ঘন ঘন কিডনি ইনফেকশন বা অপরিপূর্ণভাবে চিকিৎসিত ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) কিডনিতে স্থায়ী দাগ ফেলে।

কিডনি স্টোন: যদিও অনেক পাথর নিজে থেকেই বের হয়ে যায়, তবে বারবার ব্লকেজ কিডনি ক্ষতিতে পরিণত হয়।

ঔষধ ও বিষাক্ত পদার্থ: নিয়মিত বা মাত্রাতিরিক্ত ব্যথানাশক, কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, ক্যানসার প্রতিরোধী ওষুধ এবং স্ক্যানের জন্য ব্যবহৃত কন্ট্রাস্ট ডাই কিডনির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

বাধা সৃষ্টি: বড় হয়ে যাওয়া প্রোস্টেট, টিউমার বা ইউরিনারির সরু পথ কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে।

অটোইমিউন রোগ: যেমন লুপাস, যেখানে শরীর নিজের কিডনিকে আক্রমণ করে।

জেনেটিক সমস্যা: যেমন আলপোর্ট সিনড্রোমের মতো বিরল জিনগত রোগ।

অন্যান্য: স্থূলতা, মেটাবলিক সিনড্রোম, হৃদপিন্ডের অসুস্থতা, সিকল সেল ডিজিজ ইত্যাদিও কিডনি রোগের জন্য দায়ী।

কিডনি ক্ষয় হলে কী ঘটে?
কিডনির কাজ ব্যাহত হলে শুধু প্রস্রাব কমে যাওয়াই নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও প্রভাব পড়ে:

শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে

রক্তচাপ বেড়ে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়

পা ও ফুসফুসে পানি জমে গিয়ে ফুলে ওঠে ও শ্বাসকষ্ট হয়

হাড়, রক্ত ও স্নায়ুর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়

গুরুতর ক্ষেত্রে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া বিকল্প থাকে না

কিডনি রক্ষার উপায় কী?
আপনার হাতে এখনও সময় আছে। নিচের কিছু পদক্ষেপ কিডনি সুস্থ রাখতে কার্যকর:

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন: নিয়মিত ওষুধ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: লবণ কম খান, ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন, নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ গ্রহণ করুন।

ধূমপান বর্জন করুন: হৃদযন্ত্রের পাশাপাশি কিডনিরও ক্ষতি করে।

পর্যাপ্ত পানি পান করুন: অতিরিক্ত না, তবে শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পানি পান করা জরুরি।

সুষম ও প্রাকৃতিক খাবার খান: ফাস্ট ফুড বা অতিমাত্রায় প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।

ওষুধ সাবধানে ব্যবহার করুন: ব্যথানাশক (যেমন আইবুপ্রোফেন) নিয়মিত খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। যেকোনো ওষুধের কিডনির প্রভাব নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান: প্রোটিনের উপস্থিতি বা কিডনির কার্যক্ষমতা জানতে বছরে অন্তত একবার ইউরিন ও রক্ত পরীক্ষা করুন—বিশেষ করে যদি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন।

কিডনি হয়তো হৃদয় বা মস্তিষ্কের মতো জাঁকজমকপূর্ণ অঙ্গ নয়, তবে এগুলো নীরবে কাজ করে আপনাকে সুস্থ রাখে। যতদিন না এগুলো বিপদে না পড়ে, ততদিন কেউ টেরই পায় না। কিন্তু একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে পেছনে ফেরার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এখনই সময়—কিডনির যত্ন নিন, জীবনকে নিরাপদ রাখুন।

সূত্র: দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া।

মিরাজ খান

×