
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে জুলাই বিপ্লব : প্রত্যাশা প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন
সংখ্যানুপাতিক হারে (পিআর) ভোটের নামে দেশে জগাখিচুড়ি চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে জিয়া পরিষদ আয়োজিত ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ও জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
এর আগে সিরডাপ মিলনায়তনে ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের লেখা বই ‘অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতা : যাপিত জীবনের আলেখ্য’-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আগে ১ লাখ টাকা ঘুষ নিলে এখন নিচ্ছে ৫ লাখ।
জিয়া পরিষদের অনুষ্ঠানে ফখরুল বলেন, দেশে কিছু কিছু লোক, কিছু কিছু রাজনৈতিক দল বিভিন্ন রকম কথা বলতে শুরু করেছেন, যে বিষয়গুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্কই নেই। যেমন জোর গলায় সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের কথা বলছে।
আমাদের সাধারণ মানুষ তো বুঝেই না আনুপাতিক হারে নির্বাচনটা কী? তারা জানে যে, একজন প্রার্থীর যেই মার্কাই হোক ধানের শীষ অথবা দাঁড়িপাল্লা অথবা কুলা বা পাতা যাই হোক, সেখানে গিয়ে সে ভোটের দিন ভোট দেবে, ভোট দিয়ে একজনকে নির্বাচিত করবে। ফখরুল বলেন, আনুপাতিক হারে নির্বাচন কী জিনিস? সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলতে পারবে না। আমরা যারা রাজনীতি করি কিছুটা বোঝার চেষ্টা করি।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যারা তাদের এলাকায় একজন নেতা চায়, প্রতিনিধি চায় তাদের কাজগুলো করার জন্য একজন নেতা খুঁজে, সেটা কোনো মতেই পিআর পদ্ধতিতে সম্ভব হবে না। আমরা এ কারণেই বলেছি যে, নি¤œ কক্ষের যে পার্লামেন্ট, সেই পার্লামেন্টে আমরা আনুপাতিক হারে নির্বাচনের কথা চিন্তা করি না।
ফখরুল বলেন, আমরা কেন নির্বাচন চাই, সে দিকটা কেউ ভালো করে চিন্তা করার অবকাশ পায় না। নির্বাচন না হলে আমরা প্রতিনিধি নির্বাচন করব কী করে? আর প্রতিনিধি নির্বাচিত না হলে সে পার্লামেন্টে যাবে কী করে? আর পার্লামেন্টে না গেলে জনগণের শাসনটা প্রতিষ্ঠিত হবে কোত্থেকে? কজন ব্যক্তিকে দেশ-বিদেশ থেকে ভাড়া করে নিয়ে এসে কী দেশ চালানো যায়? যায় না।
সংস্কার রাতারাতি হয় না মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, ২০১৬ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ এর মাধ্যমে দলের সংস্কার কর্মসূচি তুলে ধরা হয়। পরে ২০২২ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফার রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল সংস্কার কর্মসূচি তুলে ধরে ফখরুল বলেন, এখন এটা রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব না।
অনেকে বলছেন, যে কজন লোক সংস্কার করছেন তারা কত বৈঠক করে সংস্কারের কতটা বিষয় নিয়ে এসে জনগণকে এগিয়ে দিলেন আর সংস্কার হয়ে গেল, সেইভাবে সংস্কার হয় না। সংস্কার হতে হবে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। আপনি চাইলেন আর কালকে পুলিশ ঘুষ খাওয়া বন্ধ করে দেবে এটা মনে করার কোনো কারণ নাই। কাঠামোটা তৈরি করতে হবে এমনভাবে, যাতে করে সে ঘুষ না খায়।
ফখরুল বলেন, বাংলাদেশে একটা ভয়াবহ সংকট উপস্থিত হয়েছে, আমরা যে এখন একটা রাজনৈতিক শূন্যতা এবং অর্থনৈতিক একটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে একটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো যেটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে, তা নিরূপণ করা প্রয়োজন। আসলে আওয়ামী লীগ যে ফ্যাসিস্ট শক্তি, তারা যে ক্ষতিটা বাংলাদেশের করে গেছে, সেই ক্ষতিপূরণ এত সহজে হবে না। তারা সমস্ত প্রতিষ্ঠাগুলোকে ধ্বংস করেছে। শুধু বিচার বিভাগ, প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস করেনি, তারা রাজনৈতিক দলগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কাছে চলে যাওয়া, জনগণের কাছ থেকে তাদের কী প্রয়োজন, তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সেটাকে নিয়ে এসে দেশ পরিচালনা করার ব্যবস্থা করা। তিনি বলেন, আজ গোটা জাতি একটা ক্রান্তিকালে পৌঁছেছে। এখন আমরা অপেক্ষা করছি ট্রানজিশনাল পিরিয়ড- গণতন্ত্র উত্তরণের একটা পথ খুঁজছি আমরা।
জিয়া পরিষদের নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবন-কর্মের ওপর গবেষণা করে তা জনগণের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
জিয়া পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় সংগঠনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক শফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের নেতা অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন জিয়া পরিষদের নেতা এমতাজ হোসেন, অধ্যাপক মজিবুর রহমান হাওলাদার, আবদুল্লাহ হিল মাসুদ, খন্দোকার শফিকুল হাসান, আলী নূর রহমান, এম জাহীর আলী, মনোয়ার হোসেন এনাম, রুহুল আলম প্রমুখ।
এদিকে সিরডাপ মিলনায়তনে ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের লেখা বই ‘অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতা : যাপিত জীবনের আলেখ্য’- এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গতকাল একজন বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেছেন- ‘আগে ঘুষ দিতাম এক লাখ টাকা, এখন দিতে হচ্ছে ৫ লাখ টাকা।’ আমি জানি না বিষয়টা কীভাবে দেখবেন আপনারা। কিন্তু এটাই সত্য।
ফখরুল বলেন, এখনো পুলিশের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং তারা আরও সুযোগ নিচ্ছে। কেউ তাদের কাছে সেবার জন্য গেলে তারা একবার বলে মন্ত্রণালয়ে যাও, আরেকবার বলে কোর্টে যাও। এভাবে পুলিশ তার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ, তাদের তো সেই কনফিডেন্স নেই। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার মতো আস্থা নেই। কারণ, গত সরকারের সব অকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল তারা। ফলে, বিষয়টি এত সহজ নয় যে, রাতারাতি সব বদলে যাবে।
ফখরুল বলেন, কোনো কিছুকে চাপিয়ে দিয়ে করা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রকে তার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলতে দিতে হবে। এজন্য কোনো রকম বিলম্ব না করে অতি দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠিয়ে সংস্কার করতে হবে। সেই সংসদের জবাবদিহিতা থাকবে। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা খুব ভালো করে উপলব্ধি করি, বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামোর গুণগত পরিবর্তন দরকার। অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে। তবে, এটা রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচনের কথা তো আমরা বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিশ্বাস করি বলে। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে গিয়ে সংস্কার করতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্যারিফ সামনে বড় বিপদে ফেলতে পারে বলে উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, সামনে অনেক বড় বিপদ আছে, ট্যারিফ অনেক বড় বিপদে ফেলতে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে এটা আমরা বুঝতে পারি। তবে, এটা বলতে পারি দেশের অর্থনীতির স্বার্থে রাজনৈতিক দল সব সময় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শিশুশ্রম নিরসনে গুরুত্ব দেবে ॥ এদিকে ঠাকুরগাঁওয়ের বেসরকারি সংস্থা ইএনডিওর প্রধান কার্যালয়ের জয়নাল আবেদিন হলরুমে ‘শিশুশ্রম নিরসনে ঠাকুরগাঁও মডেল বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও সাফল্য উপস্থাপন’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, শিশুশ্রম নিরসন করে কিভাবে কর্মজীবী শিশুদের লেখাপড়াসহ একটি সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় সেই বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে বিএনপি। জনগণের ভোটে বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে শিশুশ্রম নিরসনে প্রাধান্য দেবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে শিশুশ্রম নিরসন করাটা খুব কঠিন কাজ। এর পরও ঠাকুরগাঁওয়ের ইএসডিও এই উদ্যোগ নিয়েছে। আমি ধন্যবাদ জানাই তাদের। ইএসডিওর এই সফলতায় তারা প্রশংসার দাবিদার। আমি বিশ্বাস করি, তাদের এই সফলতা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভব। আমাদের দল এ ধরনের কাজে সব সময় পাশে থাকবে।
ইকো স্যোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-ইএসডিও-এর নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামানের সভাপতিত্বে এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রাণালয়ের সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান, সমন্বয় ও সংস্কার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব জাহেদা পারভীন, রংপুর বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) শহিদুল ইসলাম, ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার মনিটরিং কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সালমা আলীসহ আরও অনেকে। অনুষ্ঠানের শুরুতে শিশু শ্রমের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে নাটিকা পরিবেশিত হয়।
প্যানেল হু