ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

ভোর ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে ঘুম ভেঙে যায়? জানুন এর পেছনের বিজ্ঞান ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ২৬ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২২:৩৮, ২৬ জুলাই ২০২৫

ভোর ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে ঘুম ভেঙে যায়? জানুন এর পেছনের বিজ্ঞান ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা

ছবিঃ সংগৃহীত

ভোররাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া অনেকের মধ্যেই সাধারণ একটি সমস্যা। বিশেষ করে যারা প্রতিদিনই ভোর ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে যান এবং পুনরায় ঘুমাতে সমস্যা অনুভব করেন, তাদের জন্য এটি শুধুই খারাপ ঘুমের অভ্যাস নয়—বরং মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা শরীরের অভ্যন্তরীণ জৈব ঘড়ির (circadian rhythm) ব্যাঘাতের ইঙ্গিত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, এই সময়টিতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, মানসিক চাপ, বা রক্তে শর্করার ভারসাম্যহীনতা।

এমনকি প্রাচীন লোকবিশ্বাস ও আধুনিক বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাও এই সময়টিকে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করে।

"Hour of the Wolf"—রহস্যময় এক সময়

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান লোককথা অনুযায়ী, রাত ও ভোরের মাঝামাঝি সময়কে বলা হয় ‘ঘড়িয়ালের সময়’ বা “Hour of the Wolf”। সুইডিশ পরিচালক ইনগমার বার্গম্যান ১৯৬৮ সালের এক মনস্তাত্ত্বিক হরর সিনেমায় এই সময়কে ব্যাখ্যা করেছিলেন, "যখন অধিকাংশ মানুষ মারা যায়, ঘুম সবচেয়ে গভীর থাকে, এবং দুঃস্বপ্ন সবচেয়ে বাস্তব মনে হয়।"

অনেক সংস্কৃতিতে এই সময়কে “ডেভিলস আওয়ার” বা “Witching Hour” নামেও ডাকা হয়, যেটি অতিপ্রাকৃত ঘটনা বা আত্মিক অস্থিরতার সময় হিসেবে বিবেচিত।

আপনি অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশ্বাস না করলেও, এই সময়ে ঘুম ভেঙে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেক সময়ই ভয়ের অনুভূতি, দুশ্চিন্তা, একাকীত্ব বা মানসিক চাপ তৈরি করে।

বিজ্ঞান কী বলছে?

আপনার শরীর একটি ২৪ ঘণ্টার জৈব ঘড়ির মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা ঘুম, হরমোনের মাত্রা, এবং অন্যান্য মূল কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ভোর ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সময়টিতে শরীরের তাপমাত্রা সবচেয়ে নিচে থাকে, রক্তচাপ কমে যায়, ও বিপাক ক্রিয়া (metabolism) মন্থর হয়ে যায়—এই সময়টি হওয়ার কথা আপনার সবচেয়ে শান্ত ও গভীর ঘুমের। কিন্তু যখন মন বা শরীর চাপের মধ্যে থাকে, তখন এসব প্রাকৃতিক পরিবর্তনই ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।

ছোট কোনো শব্দ, দুশ্চিন্তা, কিংবা রক্তে শর্করার অস্থিরতা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তখন শরীরের প্রতিক্রিয়ায় হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, মস্তিষ্ক সচল হয়, আর ঘুম ফেরত আসে না সহজে।

মানসিক চাপ ও 'মেন্টাল লোড' এর প্রভাব

বর্তমান যুগে আমরা প্রায়শই মাথায় ভারী চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে যাই—নোটিফিকেশন, কাজের চাপ, ইমেইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চিন্তা সবই মাথায় ঘুরতে থাকে।

ঘুমের মধ্যে এগুলো মস্তিষ্কের অবচেতন অংশে জমা হয় এবং ভোররাতে, শরীর যখন সবচেয়ে দুর্বল, তখন তা আবার জেগে ওঠে। ফলে হঠাৎ করেই চিন্তা শুরু হয়—অতীত নিয়ে ভাবনা, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা, অপরাধবোধ, কিংবা অস্থিরতা।

কিছু মনোবিদ মনে করেন, এই ঘুম ভাঙার অভ্যাস হলো আপনার নার্ভাস সিস্টেমের একটি সতর্ক সংকেত, যা ইঙ্গিত দেয় আপনি অভ্যন্তরীণভাবে মানসিক চাপ, অবদমিত চাহিদা, বা অবচেতন উদ্বেগে ভুগছেন।

কীভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?

ভোররাতে নিয়মিত ঘুম ভেঙে গেলে ঘুমের রুটিন ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নিচের কৌশলগুলো সহায়ক হতে পারে—

ঘুমানোর আগে জার্নাল লিখুন: দিনের টেনশন বা পরের দিনের টুডু-লিস্ট লিখে রাখলে মস্তিষ্ক হালকা হয়।
রিলাক্সেশন টেকনিক: মেডিটেশন, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, বা মাংসপেশি শিথিলকরণ চর্চা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
স্ক্রিন টাইম কমান: ঘুমানোর অন্তত ১ ঘণ্টা আগে মোবাইল, ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন। ব্লু-লাইট ঘুম নষ্ট করে।
ক্যাফেইন ও ভারী খাবার এড়ান: রাতে কফি, অ্যালকোহল, বা ভারী খাবার খেলে ঘুম ব্যাহত হয়।
একই সময়ে ঘুমানো ও ওঠা: নিয়মিত ঘুমের রুটিন অভ্যন্তরীণ জৈব ঘড়িকে স্থিতিশীল রাখে।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি?

যদি ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে ঘুম ভাঙার সমস্যা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে এবং তা আপনার দৈনন্দিন কাজে প্রভাব ফেলে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই সময়ের ঘন ঘন ঘুম ভেঙে যাওয়ার পেছনে থাকতে পারে—
🔹 উদ্বেগ বা বিষণ্ণতা
🔹 হরমোনের ভারসাম্যহীনতা (বিশেষত মধ্যবয়সে)
🔹 ইনসমনিয়া বা ঘুমজনিত সমস্যা
🔹 অবচেতন মানসিক আঘাত

একটি ঘুমের জার্নাল রাখুন, যেখানে ঘুমের সময়, মানসিক অবস্থা, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি নোট করুন।

ভোররাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া কেবল বিরক্তিকর নয়—এটি আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের একটি দরজা খুলে দেয়। লোককথা হোক বা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, এই সময়ের গুরুত্ব বোঝা ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই আপনি ফিরে পেতে পারেন শান্তিপূর্ণ ঘুম ও ভালো সকাল।

সূত্রঃ https://timesofindia.indiatimes.com/life-style/health-fitness/health-news/why-you-keep-waking-up-between-3-and-5-am-what-it-really-means/articleshow/122807702.cms

ইমরান

×