ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

“গাজায় বিমান থেকে ফেলা ত্রাণেই হতে পারে চাপা পড়ে মৃত্যু”—সাহায্য সংস্থাগুলোর সতর্কতা

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ২৭ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০৭:৪৮, ২৭ জুলাই ২০২৫

“গাজায় বিমান থেকে ফেলা ত্রাণেই হতে পারে চাপা পড়ে মৃত্যু”—সাহায্য সংস্থাগুলোর সতর্কতা

ছবিঃ রয়টার্স

গাজা উপত্যকায় বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা হচ্ছে—এই বিষয়টিকে "একটি ভয়ানক বিভ্রান্তি" হিসেবে আখ্যা দিয়েছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো। তারা বলেছে, এই উদ্যোগ গাজার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর নয়।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, রবিবার সকালে তারা গাজায় মানবিক সহায়তা ফেলার কাজ শুরু করেছে এবং জাতিসংঘের ত্রাণ বহনকারী যানবাহনের জন্য মানবিক করিডোর চালু করার কথাও জানিয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডান আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বিমান থেকে ত্রাণ ফেলার পরিকল্পনা করছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, তার সরকার গাজায় ত্রাণ পাঠাতে “সম্ভব সবকিছুই করছে।”

তবে ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির (IRC) কিয়রান ডনেলি বলেন, “বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা কখনও প্রয়োজনীয় পরিমাণ ও মানসম্পন্ন সহায়তা দিতে পারবে না।”

অন্তত ১০০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও সাহায্য সংস্থা গাজায় দুর্ভিক্ষ নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্যমতে, গাজার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দিনের পর দিন না খেয়ে আছে। প্রায় ৯০ হাজার নারী ও শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে এবং অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন। এই পরিস্থিতিকে "মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ" বলে অভিহিত করেছে সংস্থাটি।

হামাস-চালিত গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার আরও পাঁচজন অপুষ্টিতে মারা গেছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৭ জনে, যার মধ্যে ৮৫ জন শিশু।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা UNRWA-এর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা “ব্যয়বহুল, অকার্যকর এবং ভুল হলে ক্ষুধার্ত মানুষদের প্রাণহানিও ঘটাতে পারে।”

তিনি জানান, জর্ডান ও মিশরে তাদের কাছে প্রায় ৬,০০০ ট্রাকের সমপরিমাণ ত্রাণ প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু এসব প্রবেশের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নিরাপদ পথ দরকার।

“সরাসরি সড়কপথে ত্রাণ পাঠানো অনেক সহজ, কার্যকর, দ্রুত, সস্তা ও নিরাপদ। এটি গাজার মানুষের জন্যও অধিক মর্যাদাপূর্ণ,” বলেন লাজারিনি।

ইসরায়েল বলেছে, তারা জাতিসংঘের ত্রাণ বহরের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপন করবে, তবে কোথায় ও কীভাবে এসব করিডোর পরিচালিত হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়নি।

ইসরায়েল দাবি করছে, গাজায় ত্রাণ প্রবেশে কোনো বাধা নেই এবং জাতিসংঘ ‘হামাসের সঙ্গে মিলে’ ত্রাণ বিতরণে বাধা দিচ্ছে। তবে জাতিসংঘ তা অস্বীকার করে বলেছে, ইসরায়েলি জটিলতার কারণে তারা গাজায় ত্রাণ সংগ্রহ করতে পারছে না।

হামাস জানিয়েছে, তারা ত্রাণ চুরি করছে না। ইউএসএইড-এর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ত্রাণ চুরির কোনও প্রমাণ মেলেনি।

এটি প্রথমবার নয়, পশ্চিমা ও আরব দেশগুলো গাজায় বিমান থেকে ত্রাণ ফেলার চেষ্টা করছে।

গত বছর যুক্তরাজ্যের রয়্যাল এয়ার ফোর্স ১০টি ফ্লাইটে মোট ১১০ টন ত্রাণ ফেলেছিল জর্ডান-নেতৃত্বাধীন একটি আন্তর্জাতিক জোটের অংশ হিসেবে।

তবে সাহায্য সংস্থাগুলোর মতে, এসব প্রচেষ্টা গাজায় চলমান দুর্ভিক্ষ রোধে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। বিবিসির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গাজার ২০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একবেলার খাবার দিতে অন্তত ১৬০টি প্লেন প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের (Centcom) তথ্য অনুযায়ী, তাদের একটি সি-১৩০ কার্গো প্লেন প্রতি ফ্লাইটে প্রায় ১২,৬৫০টি খাবার পরিবহন করতে পারে।

এর মানে দাঁড়ায়, গাজার পুরো জনগণের জন্য মাত্র একবেলার খাবার পৌঁছাতে হলে ১৬০টিরও বেশি ফ্লাইট প্রয়োজন।

জর্ডানের আছে প্রায় ১০টি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের আছে ৮টি সি-১৩০ কার্গো প্লেন।

এদিকে, বহু সাহায্য সংস্থা হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে হাজার হাজার টন খাবার আকাশ থেকে ফেলা হলে তা গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিপর্যয় ঘটাতে পারে।

নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের শাইনা লো বলেন, লোকজন খাবার তুলতে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে গেছে, আবার অনেকেই আকাশ থেকে পড়ে আসা বাক্সে চাপা পড়ে আহত বা নিহত হয়েছে।

তিনি বলেন, “যখন এসব ঠিকঠাকও নামে, তখনও সেখানে হট্টগোল, সংঘর্ষ, আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।”

গাজাবাসীদের মধ্যেও এই বিমান থেকে ত্রাণ ফেলার পদ্ধতি নিয়ে আতঙ্ক রয়েছে। একজন বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, “আকাশ থেকে খাবার ফেলা হলে তা তাবুর ওপর পড়ে গিয়ে গুরুতর ক্ষতি, এমনকি প্রাণহানিও ঘটাতে পারে।”

একজন মা বিবিসিকে বলেন, “আমরা কোনো খাবার বা পানি ছাড়া বেঁচে আছি। না খাবার, না রুটি, এমনকি পানিও নেই। আমরা শুধু এক ফোঁটা পানির জন্য আকুল।”

প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত এবং ২৫১ জন অপহৃত হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে।

হামাস-চালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ৫৯,০০০’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

ইসরায়েল মার্চের শুরুতে গাজায় পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে এবং দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে ফের অভিযান শুরু করে। তারা বলেছে, হামাসের কাছে থাকা অপহৃতদের মুক্ত করতে এই চাপ প্রয়োগ করছে।

অবরোধ শিথিল করা হলেও গাজায় খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির ঘাটতি আরও বেড়েছে।

গাজার অধিকাংশ মানুষ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ৯০ শতাংশের বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সূত্র: রয়টার্স

নোভা

×