
বাংলাদেশের ওপর মালয়েশিয়ার খড়গ!
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি পাঠানো দূরে থাক, উল্টো সেদেশ থেকে ফেরত আসছে। আর গত দেড় বছর ধরে আটকে পড়া ভিসাধারী ১৭ হাজার শ্রমিক পাঠানো যেখানে সম্ভব হয়নি, যখন মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেট ভেঙে নতুন শ্রমিক পাঠানো যাচ্ছে না, সেখানে উল্টো অবৈধ অভিবাসী ঠেকানোর কথা বলে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে মালয়েশিয়া। তারই অংশ হিসেবে, ভিজিট ভিসায় যাওয়া সন্দেহভাজনদের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (কেএলআইএ) থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার এই কঠোরতার খড়্গে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ। গত ১৪ জুলাই ওই বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো বিভিন্ন দেশের ১৩১ ব্যক্তির ৯৬ জনই বাংলাদেশি। মালয়েশিয়ার বর্ডার কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রটেকশন এজেন্সি (বিসিপিএ) বলেছে, সঙ্গে পর্যাপ্ত অর্থ না আনা, নির্ভরযোগ্য আবাসনের প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হওয়া এবং ইমিগ্রেশন চেকপয়েন্টে সঠিকভাবে রিপোর্ট না করার কারণে ওই ১৩১ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের কেউ কেউ এক মাস থাকার কথা জানালেও সঙ্গে ছিল মাত্র ৫০০ রিঙ্গিত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়ার এই কঠোরতায় বিপুল সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর ঘটনা উদ্বেগজনক। এটা এই দেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। তারা বলছেন, এসব কাজে বাংলাদেশী একাধিক চক্র জড়িত রয়েছে। তথাকথিত ফ্রি ভিসার নামে যাদের পাঠানো হচ্ছে, তারা মূলত বৈধ কাগজ নিয়েও অবৈধ পরিস্থিতিতে পড়ছেন।
বিএমইটির ছাড়পত্র নেওয়ার পর দেখা যায়, যে কোম্পানিতে পাঠানো হয়েছে সেখানে কোনো কাজ নেই। ৫-৬ লাখ টাকা খরচ করে যাওয়া শ্রমিক বাধ্য হন অন্যত্র কাজ নিতে, যা পুরোপুরি অবৈধ বলছেন তারা। এর আগেও ভিসাসহ সব ধরনের কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও ঢাকা থেকে ১৭ হাজার শ্রমিক যেতে পারেনি শুধু বিমানের টিকিটের অভাবে। এখনো তারা কাঁদছেন পাসপোর্ট হাতে নিয়ে। প্রশ্ন করছেন, কবে নাগাদ যাওয়া যাবে। এর উত্তর কেউ দিতে পারছেন না। না সরকার, না রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো।
গত ১১ জুলাই বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১-এর গেট সি-১ থেকে সি-৩৭ পর্যন্ত বিসিপিএর নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। এতে ৩০০ জনের বেশি যাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ ও কাগজপত্র যাচাই করা হয়। শেষে ১২৯ বাংলাদেশি, ৩০ পাকিস্তানি ও ৫ ইন্দোনেশীয় নাগরিককে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগ এক বিবৃতিতে বলেছে, ভুয়া নথি, অস্পষ্ট আর্থিক সক্ষমতা বা সন্দেহজনক উদ্দেশে কেউ মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে চাইলে, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ার বর্ডার কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রটেকশন এজেন্সি মোট ২ হাজার ৬৫৪ বিদেশি যাত্রীর কাগজপত্র যাচাই করে। তাদের ৯০০ জনের প্রবেশ বাতিল করা হয়, যাদের বড় অংশ ছিলেন বাংলাদেশি নাগরিক। তারা ভিজিট ভিসায় এলেও প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল কাজ করা। বিভিন্ন সময় ভুয়া আমন্ত্রণপত্র দেখিয়েও মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করা হয়েছে।
গত ২৪ জানুয়ারি ‘মালয়েশিয়ান ফিশারিজ অ্যাকাডেমি’-এর ভুয়া আমন্ত্রণপত্র দেখিয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে ধরা পড়েন ১২ বাংলাদেশি। প্রতিষ্ঠানটি পরে নিশ্চিত করেছে, তারা কাউকে আমন্ত্রণ জানায়নি। ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪৫ বাংলাদেশিকে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়। তারা ইমিগ্রেশন কাউন্টারে না গিয়ে বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফিরা করছিলেন। পরে তাদের ‘নোটিস টু লিভ’ (এনটিএল) দিয়ে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে গত শুক্রবার মালয়েশিয়ার একটি পত্রিকা লিখেছে- কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সম্প্রতি মোট ১৯৮ বিদেশি নাগরিকের প্রবেশ প্রত্যাখ্যান করে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যাদের মধ্যে ১২৩ জনই বাংলাদেশি। শুক্রবার সকালে এক প্রতিবেদনে দেশটির গণমাধ্যম মালয় মেইল জানিয়েছে, অভিবাসন শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া পর্যাপ্ত তহবিল না থাকা, আবাসনের বুকিং না থাকা এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্য অস্পষ্ট থাকাকে এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রবেশ প্রত্যাখ্যান হওয়াা মোট ১৯৮ জন বিদেশি নাগরিকের মধ্যে ১২৮ জনকে টার্মিনাল-১ থেকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে ১২৩ জন বাংলাদেশি, ২ জন পাকিস্তানি, ২ জন ইন্দোনেশিয়ান এবং এক সিরীয় নাগরিক। অন্যদিকে, টার্মিনাল-২ থেকে আটক করা হয়েছে বাকি ৭০ জনকে। এর মধ্যে ৫১ জন ইন্দোনেশিয়ান, ১৩ জন ভারতীয়, ৪ জন পাকিস্তানি এবং ২ জন ভিয়েতনামের নাগরিক।
মালয়েশিয়ান সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা সংস্থা (একেপিএস)-এর মহাপরিচালক দাতুক সেরি মোহাম্মদ শুহেইলি মোহাম্মদ জাইন জানিয়েছেন, যাদের প্রবেশ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, তাদের নট টু ল্যান্ড (এনটিএল) পদ্ধতির অধীনে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সগুলোই তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ করবে।
তিনি আরও জানান, বেশ ক’জন আটককৃতের ফোনে একেপিএস কর্মকর্তাদের ছবি পাওয়া গেছে, যা সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই ছবিগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজর এড়াতে সহায়তা করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছিল। মালয়েশিয়াকে যেন অবৈধ প্রবেশের ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহার করা না হয়- তা নিশ্চিত করতে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও জনশক্তি কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়ায় আপাতত জনশক্তি রপ্তানি স্থগিত। কিন্তু তারপরও কিছু মানুষ ভিজিট ভিসায় যাচ্ছে- ট্রাভেল ট্যুর কিংবা অন্য কোনো দালালের মাধ্যমে। তারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দেশটিতে কাজের জন্য যাচ্ছে ভিজিট ভিসায়। যা সম্পূর্ণ অন্যায়। তাদেরই মালয়েশিয়ার এয়ারপোর্ট থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এভাবে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো হোক এটা আমরাও চাইনি। তারপরও কিছু যাচ্ছে। আর তাদের কাগজপত্র ঠিক না থাকায় এয়ারপোার্টেই ধরা পড়ছে। তবে আমরা আশবাদী প্রধান উপদেষ্টা খুব শীঘ্রই মালয়েশিয়ায় সফরে যাচ্ছেন। তখন এটার একটা সুখবর পাওয়ার বিষয়ে ঢাকা খুবই আশাবাদী।
প্রবাসী সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দরে সন্দেহভাজন যাত্রীদের নির্দিষ্ট কাউন্টারে নিয়ে দেশটিতে প্রবেশে সহায়তা করা ‘কাউন্টার সেটিং’ চক্রে জড়িত ৫০ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা ও চক্রের ১০ সদস্যকে ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। শুধু কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরেই নয়, মালয়েশিয়াজুড়ে চলছে অবৈধ অভিবাসীবিরোধী অভিযান। সম্প্রতি পাহাং রাজ্যে অভিযানে ৪৮ বাংলাদেশিসহ ১৩১ অবৈধ অভিবাসীকে আটক করা হয়। এদের বিরুদ্ধে বৈধ পাস না থাকা, অতিরিক্ত সময় অবস্থানের অভিযোগ আনা হয়।
গত ৩ জুন পেনাং রাজ্যের বায়ান লেপাস শিল্প এলাকায় নির্মাণাধীন একটি গাড়ি পার্কিং স্থানে অভিযানে ২৯৭ বাংলাদেশি শ্রমিককে আটক করা হয়। সেদিন মোট ৫২০ জনের কাগজপত্র যাচাই করে ৩১৪ জনকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে আরও ছিলেন পাকিস্তানের ১৩, মিয়ানমারের দুই, ভারতের এক এবং ইন্দোনেশিয়ার এক নাগরিক। মালয়েশিয়ায় নির্মাণ, কৃষি ও পরিষেবা খাতে অনেক অভিবাসী শ্রমিক কাজ করেন। বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক বৈধ ভিসা পেলেও নামসর্বস্ব কোম্পানির কারণে কাজ পান না এবং বাধ্য হয়ে অবৈধভাবে অন্যত্র কাজ নেন। ফলে তারা আইনি সুরক্ষা, চিকিৎসা ও বিমার সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন।
এদিকে, বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, সৌদি আরবের পর মালয়েশিয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। কয়েক বছর পর ২০২২ সালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললে ওই বছর ৫০ হাজার ৯০ জন সেদেশে যান। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৩ জনে। ২০২৪ সালে ৯৩ হাজার ৬৩২ জন এবং ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত গেছেন মাত্র ৩ হাজার ৪৮৬ জন। কর্মী পাঠানো নিয়ে নানা অনিয়মের কারণে এই শ্রমবাজার বারবার বন্ধ হয়েছে। এই অনিয়মের সঙ্গে চক্র জড়িত।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) কয়েকজন সদস্য জানান, সরকার নির্ধারিত ৮০ হাজার টাকার স্থলে কর্মীপ্রতি ৫-৬ লাখ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ৫০ জনের জায়গায় ৫০০ জন পাঠানো হচ্ছে। এতে একদিকে শ্রমিকেরা বিদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, অন্যদিকে শ্রমবাজার নষ্ট হচ্ছে। এদিকে, গত বছর প্রকাশিত সিপিডির ‘একটি উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ’ শ্বেতপত্র অনুযায়ী, মাত্র দেড় বছরে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়ে ১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সির চক্র প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত কর্মী পাঠানোর অভিযোগও রয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হিসেবে চার সাবেক সংসদ সদস্যের নাম এসেছে। তারা হলেন -আ হ ম মুস্তফা কামাল, নিজাম উদ্দিন হাজারী, বেনজীর আহমেদ ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বায়রার নেতা ফখরুল ইসলাম বলেন, আমরা হতাশ। আমরা বিস্মিত। কারণ বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ে যেই সিন্ডিকেট ছিল, এখনো সেটাই বহাল তবিয়তে রাখার পাঁয়তারা চলছে। যেখানে দায়িত্ব নেওয়ার পর উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাহেব বলেছেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে করা বিদ্যমান এমওইউ -এর কারণেই, দুর্নীতি ও অনিয়ম করা হয়েছে। তাহলে এখনো কেন বাতিল করা হচ্ছে না সেই সিন্ডিকেট।
তিনি বলেন, ঢাকা থেকে কোন কোন এজেন্সি জনশক্তি পাঠাবে সেটা কি মালয়েশিয়া ঠিক করে দেবে? নেপালের মতো দেশ যখন মালয়েশিয়ার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে, নিজেরাই রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাই করেছে, সেখানে আমরা পারছি না। আমাদের উচিত ছিল বর্তমান সিন্ডিকেট ভেঙে নতুন করে সব ঠিক করা। আসলে আমরা হতাশ, এ কারণে যে আমরা না পারছি আটকে পড়া ১৭ হাজার ভিসাধারী লোককে মালয়েশিয়া পাঠাতে, না পারছি সেখান থেকে ডিপোর্ট করার উদ্যোগ ঠেকাতে। এটাই আমাদের নিয়তি। এভাবেই খড়্গ নেমেছে আমাদের ওপর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, তথাকথিত ফ্রি ভিসার নামে যাদের পাঠানো হচ্ছে, তারা মূলত বৈধ কাগজ নিয়েও অবৈধ পরিস্থিতিতে পড়ছেন। বিএমইটির ছাড়পত্র নেওয়ার পর দেখা যায়, যে কোম্পানিতে পাঠানো হয়েছে সেখানে কোনো কাজ নেই। ৫-৬ লাখ টাকা খরচ করে যাওয়া শ্রমিক বাধ্য হন অন্যত্র কাজ নিতে, যা পুরোপুরি অবৈধ।
প্যানেল হু