
সরীসৃপ প্রাণী সাপ সাধারণত লোকালয় থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। তবে বর্ষাকালে তাদের আবাসস্থল সংকুচিত হয়। ফলে তারা চলে আসে লোকালয়ে। অবধারিতভাবেই মানুষের চলাচলের পথে তাদের চলতে হয়। আর এতেই বাধে বিপত্তি। ভয় পেয়ে মানুষকে কামড় দিয়ে বসে এ প্রাণীটি। ফলে বর্ষাকালে সাপে কামড়ানোর ঘটনা বেড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর ৫৪ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে আহত হন। এরমধ্যে ১৮-২৭ লাখ মানুষ বিষধর সাপের আক্রমণের শিকার হন। সংস্থাটি আরো বলছে, ৪১৪১০-১৩৭৮৮০ জন সাপের কামড়ে প্রতিবছর মারা যান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী আরো জানা যায়, বিশ্বে প্রতিবছর সাপের কামড়ে সবচাইতে বেশি মারা যায় ভারতে- ৪৬৯০০ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চল- ৭০০০-২০০০০ জন। এবং অত্যন্ত শঙ্কার কথা, সাপের কামড়ে মৃত্যুর দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। স্থানীয় এক গবেষণার বরাতে সংস্থাটি জানায়, এখানে প্রতিবছর ৬০৪১ জন মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। দিনের হিসাব করতে গেলে প্রতিদিন গড়ে সাপের কামড়ে মারা যায় প্রায় ১৭ জন!
২০২৩ সালে 'ন্যাশনাল সার্ভে অন এ্যানুয়াল ইন্সিডেন্স এ্যান্ড এপিডেমিওলজি অফ স্নেক বাইট ইন বাংলাদেশ'- শিরোনামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রতিবছর ৭৫০০ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। আক্রান্ত জীবিতদের মধ্যে একটি বড় সংখ্যক মানুষ স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। এ গবেষণা থেকে আরো জানা যায়, সাপের কামড়ের ঘটনা ৯৫ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে ঘটে এবং আক্রান্ত প্রতি ৫ জনের ৪ জন পুরুষ ও ১ জন নারী। এছাড়াও প্রতিবছর ২৫০০ টি গরুও সাপের কামড়ে মারা যায় বলে জানায় গবেষণাটি। এই গবেষণাটি অনুযায়ী প্রতিদিনের হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২১ জন! সারাদেশে বর্ষাকাল শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন বিভিন্ন স্থানে সাপে কামড়ের ঘটনা বছরের অন্যান্য সময়ের চাইতে বেশি আসতে শুরু করেছে বা করবে। সারা বছরের মৃত্যুর ঘটনা প্রতিদিনের হিসেবে ১৭-২১ জন হলেও এই সংখ্যাটি বর্ষাকালে কয়েক গুণ পর্যন্ত যৌক্তিকভাবেই বেড়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষ প্রবলভাবে কুসংস্কার আচ্ছন্ন। সাপের কামড়ে কেউ আহত হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নিকটস্থ সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে না নিয়ে, নিয়ে যাওয়া হয় ঝাড়ফুঁক করার জন্য, 'ওঝা'র কাছে। জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ১০৮ ধরনের সাপ পাওয়া যায় এর মধ্যে ১৮-৩১ ধরন বিষধর। সুতরাং অধিকাংশ সাপের কামড় প্রাণঘাতী হয় না। তাই ওঝার কাছে নিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী (আপনা আপনি) ভালো হয়ে যায়! আর এই বিশ্বাসের উপর ভর করে বিষধর সাপের কামড়ে আহত ব্যক্তিকেও সবাই নিয়ে যান ওঝার কাছে। এতে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে রোগী মারা যান। কত গুলো বিষয়ে সচেতন থাকলে বর্ষায় সাপের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকা যেতে পারে: ১। চলাচলে টর্চলাইট, লাঠি ও গামবুট ব্যবহার করা, ও ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা, ২। বাড়িঘর ও আশেপাশ পরিষ্কার রাখা, ৩। পঁচা কাঠ, আবর্জনা, ইঁদুর ও ব্যাঙ নিয়ন্ত্রণ এবং পোকামাকড় নির্মূল করা, ৪। বাড়ির ফাটল, গর্ত বন্ধ রাখা, অর্থাৎ সাপ ঢোকার সম্ভাব্য রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে, ৫। সাপ কামড় দিলে তৎক্ষণাৎ নিকটস্থ সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে (উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) নিয়ে যেতে হবে, ৬। সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে এবং 'এন্টি ভেনম' থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সকল উপকরণের ব্যবস্থা প্রান্তিক পর্যায়ের হাসপাতাল গুলোতে রাখতে হবে। তবে সকল উদ্যোগে ব্যর্থ হবে, যদি আপামর জনসাধারণ সচেতন না হয়। সুতরাং সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সাপে কাটা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা সহ 'করণীয়' এবং 'বর্জনীয়' নিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করে, আমরা সাপের বিষে মৃত্যু হার ও সংখ্যা অনেকটা কমিয়ে দিতে পারি।
লেখক,
এস এম নাহিদ হাসান
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি
আঁখি