ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

বিদেশে বেড়ে ওঠা, দেশ কোথায়?

শরিফুল খান প্লাবন

প্রকাশিত: ২২:১৭, ২৬ জুলাই ২০২৫

বিদেশে বেড়ে ওঠা, দেশ কোথায়?

প্রবাসে জন্ম নেওয়া কিংবা ছোট বয়সে বিদেশে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের অনেকেই জীবনের এক গভীর সংকটে বড় হয়—“আমি কে?” তাদের মুখে বাংলা উচ্চারণ দুর্বল, দেশ নিয়ে আবেগ অনিশ্চিত, আর নিজেদের পরিচয় নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে। একদিকে তারা বিদেশি সমাজে মিশে যেতে চায়, অন্যদিকে বাবা-মায়ের শিকড় তাদের মনে করিয়ে দেয় এক ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার অস্তিত্ব। এই দ্বৈত টানাপোড়েন তাদের বেড়ে ওঠাকে করে তোলে জটিল, সংবেদনশীল ও অনেকক্ষেত্রে আত্মবিচ্ছিন্ন।

সংস্কৃতির সংঘাত: বাড়ি আর বাইরে

যেসব প্রবাসী বাবা-মা নিজ সন্তানদের বাংলা সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুশাসনে বড় করতে চান, তারা ঘরের ভেতর এক পরিবেশ তৈরি করেন। কিন্তু ঘরের বাইরের জগৎ—স্কুল, বন্ধু, টিভি, ইন্টারনেট—সবই সেই সংস্কৃতির বিপরীত। ফলে সন্তানদের মাঝে তৈরি হয় দ্বৈততা। যেমন, স্কুলে সে হয়তো হ্যালোইন বা ক্রিসমাস উদযাপন করছে, আর বাড়িতে বাবা-মা চাইছেন পবিত্র ঈদ বা একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কিছু শিখুক। এই দ্বন্দ্ব যদি সঠিকভাবে মোকাবিলা না করা হয়, তাহলে সন্তান হয় একটি পরিচয়ের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে, নয়তো একটিকে একেবারে বর্জন করে।

ভাষা হারানো মানে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্নতা

বাংলা ভাষা হচ্ছে আমাদের আত্মার পরিচয়। কিন্তু বিদেশে বেড়ে ওঠা অনেক শিশু বাংলায় কথাই বলতে পারে না, বুঝতে পারে খুব সামান্য। অনেক বাবা-মা ব্যস্ত জীবনের কারণে সন্তানদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন না বা চান না তাদের “অ্যাকসেন্ট খারাপ হোক”। এর ফল দাঁড়ায় ভয়ানক—সন্তানদের সঙ্গে দাদু-দাদী, নানু-নানার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
একটি শিশু যদি নিজের ভাষায় আবেগ প্রকাশ করতে না পারে, তাহলে নিজের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে তার সংযোগ দুর্বল হয়। তখন সে শুধু জন্মস্থান দিয়ে পরিচিত হয়, হৃদয়ের শিকড় থাকে শূন্য।

পরিচয়ের দ্বন্দ্ব: আমি কি বাংলাদেশি, না বিদেশি?

‘আমি কি বাংলাদেশি, না আমেরিকান?’, ‘আমি কি মুসলিম, না আধুনিক?’—এমন অসংখ্য প্রশ্ন তাদের মনে জন্ম নেয় যখন তারা বন্ধুদের থেকে আলাদা আচরণ করতে বাধ্য হয়। অনেক শিশু স্কুলে মজা করে বাংলা নাম নিয়ে ঠাট্টার শিকার হয়। কেউ কেউ তাদের সংস্কৃতি বা খাবার নিয়ে লজ্জা পায়।
এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ নিজের নাম, পোশাক, ধর্মীয় রীতি সব বাদ দিয়ে দেয়; আবার কেউ কেউ উল্টো চরম ধর্মীয় বা জাতিগত জড়তায় ঢুকে পড়ে। উভয় পথই চিন্তার কারণ।

অভিভাবকদের ভূমিকা: বাধ্য নয়, বোঝাপড়ার শিক্ষা

প্রবাসে সন্তানদের বেড়ে ওঠা সহজ নয়। তাই অভিভাবকদের দায়িত্বও অনেক বেশি। অনেক বাবা-মা শুধু “বাংলাদেশি হতে হবে” চাপ দেয়, কিন্তু সন্তানদের মনোজগৎ বোঝে না। এতে দূরত্ব বাড়ে। আবার কেউ কেউ সন্তানের উপর অতিরিক্ত বিদেশি প্রভাব দেখে হাল ছেড়ে দেন।
সঠিক পথ হলো—ভালোবাসা, সংলাপ আর ধৈর্যের মাধ্যমে শিশুদের দ্বৈত সংস্কৃতির সৌন্দর্য বুঝিয়ে দেওয়া। বাংলা শেখানো, দেশীয় উৎসব উদযাপন, ছুটিতে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া, আর বিদেশি সমাজের ভালো দিকগুলোকেও গ্রহণ করতে শেখানো—এই ভারসাম্যই পারে তাদের আত্মপরিচয় গড়তে সাহায্য করতে।

বাংলাদেশি স্কুল ও সাংস্কৃতিক সংগঠন: আশার আলো

বিদেশে অনেক বাংলাদেশি কমিউনিটি শিশুদের জন্য বাংলা স্কুল চালু করেছে, সংস্কৃতি চর্চা করে। সেখানে গান, কবিতা, নাচ, একুশে ফেব্রুয়ারি বা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে শিশুদের সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। এতে তারা বোঝে, “বাংলাদেশি পরিচয় লজ্জার নয়, গর্বের।”

তৃতীয় সংস্কৃতির নাগরিক: এক নতুন পরিচয়

বিদেশে বেড়ে ওঠা সন্তানেরা বাস্তবে এক নতুন পরিচয়ের প্রতিনিধি—তারা “তৃতীয় সংস্কৃতির নাগরিক” (Third Culture Kid)। অর্থাৎ, তারা বাবা-মায়ের সংস্কৃতিতেও পুরোপুরি না, আবার যে দেশে বড় হচ্ছে, তাতেও পুরোপুরি না। তারা নতুন এক আত্মপরিচয় গড়ছে—যেটি বহুমাত্রিক। আমাদের দায়িত্ব সেই পরিচয়কে বোঝা ও গ্রহণ করা।

শেষ কথা

প্রবাসে বেড়ে ওঠা সন্তানদের ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের টানাপোড়েন একটি বাস্তবতা—যেটি শুধু তাদের নয়, আমাদের সবার। আমরা যদি তাদের সঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা করি, সহমর্মিতা দেখাই, ও ভালোভাবে পথ দেখাই—তাহলে এই প্রজন্মই হবে একদিন বাংলাদেশের গর্বিত মুখপাত্র, বিদেশের মাটিতে।
 

শরিফুল খান প্লাবন 
সাংবাদিক ও কলাম লেখক

 

রাজু

×