
কল্পনা আর বাস্তবতার সীমারেখা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে
আমরা দাঁড়িয়ে আছি ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে- এমন এক সময়ের মোহনায়, যেখানে কল্পনা আর বাস্তবতার সীমারেখা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে। প্রতিটি নতুন প্রভাতে আমরা জেগে উঠছি এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে গতকালের চেনা নিয়ম, চেনা কাঠামো, এমনকি চেনা চিন্তাও অচল হয়ে পড়ছে। পরিবর্তন আজ আর ধীরে ধীরে নয়তা ছুটে আসছে ঘূর্ণিঝড়ের মতো, আর আমরা, একবিংশ শতকের এই পথচারীরা, সেই ঘূর্ণাবর্তে নিজের অবস্থান খুঁজে নেওয়ার চেষ্টায় নিয়ত সচেষ্ট।
যা এক সময় শুধু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পাতায় সীমাবদ্ধ ছিল, তা আজ প্রযুক্তির স্পর্শে হয়ে উঠছে জীবন্ত বাস্তবতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, মেটাভার্স, সাইবারনেটিক দেহাংশÑ এসব আর দূরের গল্প নয়। এগুলোই গড়ে তুলছে সেই নতুন জগৎ, যেখানে মানুষকে শুধু জ্ঞান নয়, প্রজ্ঞা নিয়েই সামনে এগোতে হবে।
এই আগামীর পৃথিবী অভ্যর্থনা জানাবে তাদেরই, যারা প্রস্তুত পরিবর্তনের জন্য। যারা সাহস করে পুরানো অভ্যাসের আবরণ ছিঁড়ে ফেলতে পারে, যারা নিরন্তর শিখতে পারে এবং নিজেদের ভেতরে গড়ে তুলতে পারে এক গভীর আত্মসচেতনতা। নতুন শতাব্দীর এই পৃথিবী আমাদের সামনে তুলে ধরছে এক দ্বৈত প্রতিচ্ছবিÑ এ একদিকে অপার সম্ভাবনার, অন্যদিকে গভীর চ্যালেঞ্জের। এটি যেমন প্রযুক্তির বিজয়গাথা, তেমনি মানবিক মূল্যবোধের এক কঠিন পরীক্ষা।
সুতরাং এখন আর প্রশ্ন নেই, পরিবর্তন আসবে কি না। প্রশ্ন একটাই- আমরা প্রস্তুত তো? প্রস্তুত এই নতুন পৃথিবীর ভাষা বুঝতে, প্রস্তুত এর নীতি ও নৈতিকতাকে উপলব্ধি করতে, প্রস্তুত একটি প্রযুক্তিনির্ভর জগতে মানবিকতা বাঁচিয়ে রাখতে? এই নিবন্ধে আমরা সন্ধান করব সেই ভবিষ্যতের পথরেখা, যেখানে প্রযুক্তি শুধু হাতিয়ার নয়Ñ একটি জীবনদর্শন। আর সেই দর্শন বুঝে গড়ে তুলতে হবে নতুন প্রস্তুতি, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি, এক নবীন প্রজ্ঞার আলো।
সুতরাং এখন আর প্রশ্ন নেই, পরিবর্তন আসবে কি না। প্রশ্ন একটাই- আমরা প্রস্তুত তো? প্রস্তুত এই নতুন পৃথিবীর ভাষা বুঝতে, প্রস্তুত এর নীতি ও নৈতিকতাকে উপলব্ধি করতে, প্রস্তুত একটি প্রযুক্তিনির্ভর জগতে মানবিকতা বাঁচিয়ে রাখতে? এই নিবন্ধে আমরা সন্ধান করবো সেই ভবিষ্যতের পথরেখা, যেখানে প্রযুক্তি শুধু হাতিয়ার নয়- একটি জীবনদর্শন। আর সেই দর্শন বুঝে গড়ে তুলতে হবে নতুন প্রস্তুতি, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি, এক নবীন প্রজ্ঞার আলো।
আইজ্যাক আসিমভ মন্তব্য করেছিলেন যে- ‘এই সময়ের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হলো- বিজ্ঞান যত দ্রুত জ্ঞান সংগ্রহ করছে, সমাজ তত দ্রুত প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারছে না।’ এই কথাটি যেন আমাদের ভবিষ্যত-চিন্তায় এক সতর্ক বীণা বাজিয়ে দেয়Ñজ্ঞান যখন দ্রুতগতিতে প্রসারিত হচ্ছে, তখন প্রজ্ঞার বিকাশ না হলে সেই জ্ঞানই বিপর্যয়ের পথ রচনা করতে পারে।
আজ যে মোবাইল ফোনটি হাতে ধরে আমরা দিন পার করছি, কয়েক বছর পর সেটিই হয়ে পড়বে পুরানো। আমরা এখন কল্পনা করছিÑএকদিন চিন্তার মাধ্যমে যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বাস্তবে সেই সময় আর খুব দূরে নয়। প্রযুক্তিবিদ এলন মাস্কের ‘নিউরাল লিংক’ প্রকল্প তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভাবুন তো, আপনি শুধু মনে করলেন ‘ফেসবুক খুলতে চাই’, আর চোখের পলকে খুলে গেল সেই অ্যাপ্লিকেশন- কোনো স্পর্শ ছাড়াই! সফটওয়্যার ও মেশিন লার্নিং এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে চলেছে, যেখানে যন্ত্র অনুভব করবে মানুষের অনুভূতি, চিন্তার সঙ্গে কাজের সমন্বয় ঘটিয়ে আরও সহজ করবে জীবনের পথচলা। একে একে কল্পনার মেঘ নামছে বাস্তবের মাঠে।
অর্থনৈতিক জগৎও এই পরিবর্তনের বাইরে নয়। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে কাগজের টাকা। জায়গা নিচ্ছে জজ কোড, ডিজিটাল ওয়ালেট, ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি। এক ক্লিকেই লেনদেন, এক স্ক্যানেই পেমেন্টÑ সব যেন হাতের মুঠোয়। আমরা যদি এখনই ডিজিটাল লেনদেন, সাইবার নিরাপত্তা বা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের জ্ঞান অর্জনে পিছিয়ে থাকি, তবে ভবিষ্যতের অর্থনীতির ট্রেনে আমাদের জন্য কোনো সিট থাকবে না।
চিকিৎসা খাতেও শুরু হয়েছে প্রযুক্তির জয়যাত্রা। ২০২৩ সালেই রোবটিক অস্ত্রোপচারে যন্ত্র দেখিয়েছে মানুষের চেয়েও বেশি নির্ভুলতা। বিশ্বের সেরা সার্জনের দক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে। রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও মনিটরিং হবে প্রায় পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর। আয়ু হয়তো বাড়বে, কিন্তু প্রযুক্তিকে বোঝার অক্ষমতা আমাদের পিছিয়ে ফেলবেÑ এ সত্যও অস্বীকার করা যায় না। পরিবহন ব্যবস্থার রূপান্তর যেন কাল্পনিক গল্পের বাস্তব রূপ। ‘বুম সুপারসনিক’ নামের প্লেন তৈরি হয়েছে, যা কয়েক মিনিটেই দূরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।
আজ যেখানে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর যেতে লাগে প্রায় ৪৫ মিনিট, ভবিষ্যতে সময়টা কমে দাঁড়াতে পারে ১০ মিনিটে। সময় হবে তখন সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। প্রতিটি সেকেন্ডই হয়ে উঠবে বিনিয়োগ, প্রতিটি সিদ্ধান্তই ভবিষ্যতের নকশা। তবে শুধু প্রযুক্তি নয়, পরিবেশও হয়ে উঠছে মানবসভ্যতার চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ক্রমেই বাড়ছে।
উন্নত রাষ্ট্রগুলো এখন কৃত্রিম উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করছে বৃষ্টিপাত, বাতাস, তাপমাত্রা। দুবাইতে গড়ে উঠেছে জলবায়ু-নিয়ন্ত্রিত শহর। আমাদের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশে এই ধরনের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন অনিবার্য হয়ে উঠছে। নয়তো আগামীতে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ধ্বংস করে দেবে সভ্যতার স্বাভাবিক ধারা।
এই পরিবর্তনের আবহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সময়চর্চা ও প্রস্তুতি। একটি দিন মানে ৮৬ হাজার ৪০০ সেকেন্ড। প্রতিটি সেকেন্ড একটি সম্ভাবনা। এই প্রতিটি মুহূর্ত যিনি কাজে লাগাতে জানেন, তিনিই হয়ে ওঠেন আগামীর পথপ্রদর্শক। শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না, স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাস। ভবিষ্যতের পৃথিবী তৈরি হচ্ছে না শুধু আমাদের জন্য; বরং আমরা কতটা নিজেদের তৈরি করছি, সেটাই হবে আমাদের টিকে থাকার মানদণ্ড।
পরিবর্তিত চিন্তা, নমনীয় অভ্যাস, আধুনিক দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস ছাড়া এই নতুন পৃথিবীতে কেউ টিকে থাকতে পারবে না। সময়ের কাছে পরাজিত হয়ে অতীতের একটি ফুটনোট হয়ে থাকতে হবে, যদি না আমরা এখনই নিজেদের রূপান্তরের পথে হাঁটি। জীবন একটাই। পুনর্জন্মের কল্পনা নয়, বর্তমানের প্রস্তুতিই ভবিষ্যতের মূল চাবিকাঠি। চুপচাপ বসে থাকলে, অতীতের সোনালি দিন নিয়ে গান গাইলেই চলবে না। বরং সময়ের ভাষা বুঝে নিজের ভেতর থেকেই শুরু করতে হবে নতুন পৃথিবীর প্রস্তুতি। মনে রাখতে হবে, যে জাতি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেয় না, তারা অতীতেই আটকে যায়।
আমরা এমন এক সময়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, যেখানে আজকের প্রতিটি সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করে দেবে আগামী দিনের গতিপথ। আমাদের সন্তানরা একদিন ফিরে তাকাবে এই সময়ের দিকেÑ জিজ্ঞাসু চোখে খুঁজবে উত্তর, তাদের ভবিষ্যতের ভিত্তি কতটা মজবুত রেখেছিলাম আমরা? তারা কি বলতে পারবেÑ ‘আমাদের মা-বাবারা শুধু স্বপ্ন দেখেননি, তাঁরা সেই স্বপ্নকে সাহসে, প্রজ্ঞায় ও প্রয়াসে বাস্তব করে তুলেছিলেন’?
এই উত্তর গড়ে উঠবে আজকের প্রস্তুতির ভিতে, আজকের দায়িত্বশীল আত্মসচেতনতার ভিতর দিয়ে। কারণ ভবিষ্যৎ আসে চুপিচুপি নয়Ñ তা আসে ছুটে, ছায়ার মতো আমাদের ঘিরে ধরে। সেই ভবিষ্যৎ এখনো অজানা, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাচ্ছি- সে ডাকছে আমাদের, বলছে- ‘নিজেকে বদলাও, বদলাও তোমার দৃষ্টিভঙ্গি, প্রস্তুত হও এক নতুন ভোরের জন্য।’ এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব আমরা চাই প্রযুক্তির হাতে না দিয়ে, মনুষ্যত্বের হাতে দিই। প্রযুক্তি আমাদের হাত শক্ত করবে, কিন্তু মনুষ্যত্ব আমাদের পথ দেখাবে। প্রজ্ঞা আমাদের ভাবাবেÑ কে আমরা? এবং কোথায় যাচ্ছি আমরা?
নতুন পৃথিবীর নির্মাতা আমরা হবোÑ শুধু প্রযুক্তির দক্ষতায় নয়, হৃদয়ের বিশুদ্ধতায়, চিন্তার স্বচ্ছতায় এবং দায়িত্ববোধের গভীরতায়। আমাদের পথচলায় থাকবে জ্ঞান, থাকবে আত্মবিশ্বাস, আর থাকবে এক সজাগ ও সদর্থক প্রয়াস, যা গড়ে তুলবে এক মানবিক ও টেকসই ভবিষ্যৎ। চলুন, আমরা সেই আহ্বানে সাড়া দিই। ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াই, মাথা উঁচু করে বলি- আমরাই সেই প্রজন্ম, যারা শুধু স্বপ্ন দেখেনি, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল।
লেখক : আইনজীবী ও গবেষক
প্যানেল হু