
ছবি: AI Generated
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ হলেও অনেক বিভাগে এখনো আসন খালি রয়েছে, যা একদিকে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিকল্পনার মধ্যকার অসামঞ্জস্যকে স্পষ্ট করে তুলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক অনুষদ বিশেষ করে কলা ও বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগে শ্রেণি শুরু হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন ফাঁকা। সাতবার ‘সাবজেক্ট মাইগ্রেশন’ শেষ হওয়ার পরও উর্দু, ফারসি, সংস্কৃত ও পালি বিভাগের মতো বিষয়ে ভর্তি সংখ্যা আশানুরূপ হয়নি।
ভর্তি পরীক্ষায় পাস কম, বিজ্ঞান অনুষদের আসন ফাঁকা
বিজ্ঞান অনুষদের ৬,১৩০টি আসনের মধ্যে ৫০৫টি আসন ফাঁকা রয়েছে। বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান, অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অনেক শিক্ষার্থী ন্যূনতম বিষয়ভিত্তিক নম্বর না পাওয়ায় ভর্তি হতে পারেননি। চলতি বছর বিজ্ঞান ইউনিটে অংশগ্রহণকারী ১,৪৬,৬৯৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৫.৯৩% পাস করেছে।
ছবি: সংগৃহীত
অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রিতে ৬০টি আসনের মধ্যে ভর্তি হয়েছে ৩২ জন, ইইই বিভাগে ৭৫টির মধ্যে ৫২ জন, এবং পদার্থবিজ্ঞানে ১০০টির মধ্যে ভর্তি হয়েছে ৬৪ জন।
ঢাবির ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশীদ বলেন, “সরকারি পাসের হার বাড়লেও এটি সফলতা নির্দেশ করে না। বরং আমরা বিদ্যালয় পর্যায়ে অতিরিক্ত নম্বর প্রদান করছি, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা ব্যর্থ হচ্ছে।”
ভাষা বিভাগের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়ে পরবর্তীতে ভর্তি বাতিল করে আবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন সুমাইয়া আফরিন (ছদ্মনাম)। বর্তমানে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অধ্যয়নরত। সুমাইয়া বলেন, “আমার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল, কিন্তু পরিবার ও আত্মীয়রা ফারসি বিষয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিল। তাই আমি পুনরায় পরীক্ষা দিয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই।”
এ ধরনের ঘটনা ভাষা বিভাগগুলোর ভবিষ্যতের প্রশ্ন তুলছে। উর্দুতে ৩৫টি, ফারসিতে ২১টি, সংস্কৃত ৩৭টি এবং পালিতে ২২টি আসন ফাঁকা রয়েছে। ২০২৩ ও ২০২২–২৩ শিক্ষাবর্ষেও এই বিভাগগুলোতে যথাক্রমে ৬১ ও ১২৯টি আসন খালি ছিল।
চীনা, জাপানি, ফরাসি, ও ভাষাবিজ্ঞান বিভাগেও ভর্তি অনাগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে।
চামড়া প্রকৌশলে কম আগ্রহ
ঢাবির লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে ১৫০টির মধ্যে মাত্র ৫৩টি আসন পূর্ণ হয়েছে। লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৫০টির মধ্যে ১৭টি, ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৫০টির মধ্যে ২৯টি এবং লেদার প্রোডাক্টস বিভাগে মাত্র ৯টি ভর্তি হয়েছে।
ইনস্টিটিউটটির পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, “আমাদের অ্যালামনাই ও চাকরির বাজার ভালো হলেও শিক্ষার্থীরা বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করছে না। বর্তমান প্রজন্ম সম্ভবত শিল্পভিত্তিক চাকরির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।”
সংগীত ও নৃত্যে অপ্রত্যাশিত শূন্যতা
ব্যবহারিক পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হওয়া সংগীত ও নৃত্য বিভাগেও আসন পূরণ হয়নি। সংগীত বিভাগে ৬০টির মধ্যে ৩৬টি ও নৃত্যে ৩০টির মধ্যে ১১টি আসন ফাঁকা।
জিওলজি, জিওগ্রাফি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি—এই বিভাগের মতো জনপ্রিয় বিষয়েও অনেক আসন খালি রয়ে গেছে।
নীতিগত ঘাটতি ও সমন্বয়হীনতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের মতে, ভর্তির নীতিতে কিছু ঘাটতি রয়েছে যা এসব সমস্যার মূল কারণ। অনেকে বলছেন, শুধু ‘সাবজেক্ট মাইগ্রেশন’ কিংবা শর্ত শিথিল করে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। ক্লাস শুরু হলে পুনরায় বিষয় পরিবর্তনের সুযোগ নেই এই নীতিও এখন পুনর্বিবেচনার দাবি রাখছে।
ঢাবির উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, “সব চেষ্টা সত্ত্বেও কিছু আসন সবসময় খালি থেকে যায়। এতে আমাদের করার তেমন কিছু থাকে না।”
অনলাইন ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করতে উপাচার্যের সঙ্গে একটি বৈঠক হবে।
ছবি: সংগৃহীত
অধ্যাপক ড. মনিনুর রশীদ বলেন, “দেশের কর্মসংস্থান কাঠামো কী ধরনের স্নাতক চায়, তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গবেষণা দরকার। এর ভিত্তিতে আমাদের আসন নির্ধারণ ও একাডেমিক পরিকল্পনা হতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ঢাবির ৮৪টি বিভাগ ও ১৩টি ইনস্টিটিউটের অনেকগুলোর কাঠামো বাজারচাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখন সময় এসেছে, প্রমাণভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আসন সংখ্যা পুনঃবিন্যাস ও শিক্ষার মান নিশ্চিত করার।”
সূত্রঃ TBS
Jahan