
ছবি: সংগৃহীত।
থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার সীমান্তে তৃতীয় দিনের মতো সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। শনিবার নতুন করে সংঘর্ষের ক্ষেত্রও সৃষ্টি হয়েছে। উভয় পক্ষই দাবি করছে, তারা আত্মরক্ষার্থে পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে এবং অপর পক্ষকে যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছে।
গত ১৩ বছরে এই দুই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশের মধ্যে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ, যাতে এখন পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছে এবং ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
শনিবার সকালে থাইল্যান্ডের উপকূলীয় প্রদেশ ত্রাট এবং কাম্বোডিয়ার পুরসাত প্রদেশে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়। এই নতুন সীমান্ত ফ্রন্টটি পূর্ববর্তী সংঘর্ষস্থল থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে।
মে মাসের শেষ দিকে এক কাম্বোডিয়ান সেনার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির অবনতি শুরু হয়। এরপর থেকেই উভয় দেশ সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে এবং কূটনৈতিক উত্তেজনা চরমে ওঠে, যা থাইল্যান্ডের দুর্বল জোট সরকারকে ভাঙনের মুখে ফেলে দেয়।
থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকে শনিবার জানানো হয়, এ পর্যন্ত ৭ সেনা ও ১৩ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। অপরদিকে, কাম্বোডিয়া জানিয়েছে, তাদের ৫ সেনা ও ৮ বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। কাম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মালি সোচেতা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী সিসাকেট প্রদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। সেখানে এক স্বেচ্ছাসেবক জানান, ৫,০০০-এর বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
৫১ বছর বয়সী সামরং খামডুয়াং জানান, বৃহস্পতিবার সংঘর্ষ শুরু হলে তিনি তার ফার্ম থেকে পালিয়ে আসেন। তবে তার স্বামী গবাদি পশুর দেখভাল করতে থেকে যান। তিনি বলেন, “আর্টিলারির শব্দে আমরা খুব ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু আমার স্বামী রয়ে গেছেন, আর এখন তার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমি জানি না তিনি কেমন আছেন।”
মালয়েশিয়ার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব
কুয়ালালামপুরে, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, যিনি আসিয়ান অঞ্চলের বর্তমান চেয়ারম্যান, জানিয়েছেন যে তিনি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো অব্যাহত রাখবেন। কাম্বোডিয়া আনোয়ারের প্রস্তাবকে সমর্থন করলেও, থাইল্যান্ড শুধু ‘নীতিগতভাবে’ একমত বলে জানিয়েছে।
বারনামা বার্তা সংস্থার মতে, আনোয়ার বলেন, “এখনও কিছু গোলাগুলি চলছে। আমি আমার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি সংশ্লিষ্ট দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, আর সম্ভব হলে আমিও নিজে যোগাযোগ চালিয়ে যাব যাতে অন্তত যুদ্ধ থামে।”
জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক
জাতিসংঘে থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে বলেন, জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে থাই ভূখণ্ডে নতুন করে পুঁতে রাখা ল্যান্ডমাইনে তাদের সৈন্য আহত হয়েছেন—যা কাম্বোডিয়া দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে। রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, এরপর বৃহস্পতিবার সকালে কাম্বোডিয়া হামলা চালায়।
থাই প্রতিনিধি চের্ডচাই চাইভাইভিড বলেন, “থাইল্যান্ড কাম্বোডিয়াকে অবিলম্বে সব ধরনের আগ্রাসন বন্ধ করতে এবং আন্তরিকভাবে সংলাপে ফিরে আসার আহ্বান জানায়।”
অন্যদিকে, কাম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলে, “থাইল্যান্ড ইচ্ছাকৃত, উসকানিমূলক ও অবৈধ সামরিক হামলা চালিয়েছে এবং সীমান্তে নতুন করে সেনা ও অস্ত্র মোতায়েন করছে।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “এই প্রস্তুতি থাইল্যান্ডের আগ্রাসন বৃদ্ধির এবং কাম্বোডিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দেয়।”
কাম্বোডিয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, “থাইল্যান্ডের আগ্রাসনকে তীব্রভাবে নিন্দা করুন” এবং এর সামরিক তৎপরতা আরও বিস্তারের চেষ্টা রোধ করুন। অপরদিকে, থাইল্যান্ড বলেছে তারা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান চায়।
দুই দেশের মধ্যে ৮১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ অচিহ্নিত সীমান্ত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলছে। এর মধ্যে প্রাচীন হিন্দু মন্দির তা মোয়ান থম এবং ১১ শতকের প্রেহ ভিহারকে কেন্দ্র করেই মূল দ্বন্দ্ব।
১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক আদালত প্রেহ ভিহার মন্দিরকে কাম্বোডিয়ার অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। তবে ২০০৮ সালে কাম্বোডিয়া মন্দিরটিকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে গেলে উত্তেজনা বাড়ে এবং কয়েক বছর ধরে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
চলতি বছরের জুনে কাম্বোডিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টির নিষ্পত্তির আবেদন জানায়, তবে থাইল্যান্ড আদালতের এখতিয়ার স্বীকার করেনি এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
সূত্র: রয়টার্স।
মিরাজ খান