
দুই মাসের টানাপোড়েনের পর অবশেষে সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। তবে সীমান্তঘেঁষা এই লড়াইয়ে জড়িত হয়ে পড়েছে বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এটিকে একটি নতুন ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ বা ছায়াযুদ্ধ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন, যেখানে মিত্র রাষ্ট্রের ছায়ায় পরাশক্তিরা নিজেদের ভূরাজনৈতিক খেলা খেলছে।
সীমান্ত বিরোধ থেকে শুরু, পরিণত হলো আন্তর্জাতিক সংঘাতে
২৪ জুলাই থেকে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ শুরু হয়। দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ এবং ঐতিহাসিক উত্তেজনার ধারাবাহিকতায় সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে দ্বিপাক্ষিক মনে হলেও এটি ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক রূপ নিতে থাকে, কারণ দুই দেশই তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সমর্থন পেতে থাকে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে চীন।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান: থাইল্যান্ডকে সামরিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ
থাইল্যান্ডকে বহু আগে থেকেই ‘মেজর নন-ন্যাটো অ্যালাই’ হিসেবে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বিমানবাহিনীতে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত এফ-৬ যুদ্ধবিমানসহ আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি রয়েছে, যা বর্তমানে সংঘাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, থাইল্যান্ডকে এই যুদ্ধবিমান ব্যবহারের অনুমতিও দিয়েছে ওয়াশিংটন, যা একপ্রকার প্রত্যক্ষ সামরিক সমর্থন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এছাড়া থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনীকে গোয়েন্দা তথ্য ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। যদিও বিষয়টি তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি।
চীনের অবস্থান: কৌশলগত বন্ধুত্ব ও সামরিক সহায়তা কম্বোডিয়াকে
অন্যদিকে, চীন বহুদিন ধরেই কম্বোডিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র। দেশটির সেনাবাহিনীকে তারা ভিটিফোর ট্যাংক, জেড-৯ হেলিকপ্টারসহ নানা চীনা অস্ত্র সরবরাহ করেছে। সংঘাত শুরুর পর থেকেই চীন কূটনৈতিকভাবে কম্বোডিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে এবং পশ্চিমা বিশ্বের ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা’-কে এই উত্তেজনার জন্য দায়ী করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দক্ষিণ চীন সাগর ঘেঁষা অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে চীন কৌশলগতভাবে এই সংঘাতে জড়িয়েছে এবং কম্বোডিয়াকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
প্রক্সি যুদ্ধের লক্ষণ: অস্ত্র, প্রযুক্তি ও কৌশলগত প্রভাব
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, পরাশক্তিদের এই বিপরীতমুখী সমর্থন সংঘাতটিকে প্রক্সি যুদ্ধের রূপ দিতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরাসরি না জড়ালেও তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্র, প্রযুক্তি এবং কৌশলগত নির্দেশনার মাধ্যমেই যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারিত হচ্ছে।
এ ধরনের পরিস্থিতির নজির অতীতেও রয়েছে। সিরিয়া, ইউক্রেন, আফগানিস্তান এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিপরীত পক্ষসমূহকে সমর্থন দিয়েছে যেমন পাকিস্তানের পক্ষে চীনের অবস্থান।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ, দীর্ঘায়িত হলে ‘নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ’
যুক্তরাষ্ট্র থাইল্যান্ডকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিল, যা থাই সরকার প্রত্যাখ্যান করে। চীনও উত্তেজনা প্রশমনের কথা বললেও যুদ্ধ থামাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কার্যত ব্যর্থ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এই যুদ্ধ শুধু থাইল্যান্ড বা কম্বোডিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আঞ্চলিক বাণিজ্য, পর্যটন, নিরাপত্তা এবং আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কেও এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি সংঘাত দীর্ঘায়িত হয় তবে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা করতে পারে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাদের নিজ নিজ মিত্রদের মাধ্যমে একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে।
Jahan