ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

একা পথ চললেন ম্যাক্রোঁ, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত ফ্রান্স

প্রকাশিত: ১৭:০৪, ২৬ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৭:০৪, ২৬ জুলাই ২০২৫

একা পথ চললেন ম্যাক্রোঁ, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত ফ্রান্স

ছবি: সংগৃহীত।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম পশ্চিমা সদস্য দেশ হিসেবে ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। এই ঘোষণায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত কূটনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

তবে এই সিদ্ধান্ত আচমকা আসেনি।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে গাজার সীমানায় অবস্থিত মিশরের আল-আরিশ শহর সফরে গিয়ে ম্যাক্রোঁ নিজ চোখে গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেন। এরপর ফ্রান্সে ফিরে তিনি ঘনিষ্ঠদের জানান, প্যারিস শিগগিরই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে।

সৌদি আরবের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে ম্যাক্রোঁ একটি পরিকল্পনা দাঁড় করান—ফ্রান্স, ব্রিটেন ও কানাডা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে, এবং একইসঙ্গে আরব দেশগুলোকে ইসরায়েলের প্রতি কিছুটা নমনীয় অবস্থানে আনতে একটি জাতিসংঘ সম্মেলন আয়োজন করা হবে।

তবে কয়েক সপ্তাহের আলোচনার পরও ব্রিটেন ও কানাডাকে এই উদ্যোগে রাজি করানো যায়নি। তিন কূটনীতিক জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়ার আশঙ্কায় লন্ডন ও অটোয়া এতে সাড়া দেয়নি, ফলে ম্যাক্রোঁ একাই পথচলা শুরু করেন।

এক ফরাসি কূটনীতিক জানান, “ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, আমাদের আর অপেক্ষা করা যাবে না। তাই ফ্রান্স এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেপ্টেম্বরের সম্মেলনের আগেই আরও দেশকে আমাদের সঙ্গে আনার চেষ্টা চলবে।”

দেশের ভেতরেও চাপ বেড়েছিল:
গাজা থেকে আসা নির্মম ছবিগুলো দেখে ফ্রান্সজুড়ে ক্ষোভ তৈরি হয়। ইউরোপের সবচেয়ে বড় মুসলিম ও ইহুদি জনগোষ্ঠী থাকার কারণে এমনিতেই দেশটি রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, এবং সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব ছিল না।

ইসরায়েল ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্তকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করে বলেছে, এটি হামাসের প্রতি একপ্রকার পুরস্কার, যাদের হামলার মাধ্যমে গত ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হয়।

ম্যাক্রোঁ বিষয়টি নিয়ে আগেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। ট্রাম্প মন্তব্য করেন, “ফ্রান্সের সিদ্ধান্তের কোনও ওজন নেই,” তবে তিনি ম্যাক্রোঁকে “ভালো মানুষ” বলে অভিহিত করেন।

জাতিসংঘ সম্মেলনের পরিকল্পনা:
আগে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে জুন মাসে জাতিসংঘে একটি সম্মেলনের আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল, যেখানে একটি টেকসই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা দেওয়া হতো এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হতো।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চাপ এবং ইসরায়েলের ইরানে বিমান হামলার কারণে সম্মেলনটি স্থগিত করা হয়।

বর্তমানে সম্মেলনের সময়সূচি পরিবর্তন করে আগামী সোমবার ও মঙ্গলবার তা মন্ত্রী পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এরপর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে দ্বিতীয় একটি উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন হবে, যেখানে ম্যাক্রোঁ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবেন।

মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা:
কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা ব্যবহার করে ম্যাক্রোঁ প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের কাছ থেকে সংস্কারমূলক প্রতিশ্রুতি আদায় করছেন এবং আরব দেশগুলোর কাছ থেকে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহায়তা চাইছেন।

কার্নেগি ইউরোপের স্ট্র্যাটেজিক ইউরোপ ব্লগের সম্পাদক রিম মমতাজ বলেন, “ম্যাক্রোঁ এক্ষেত্রে একধরনের অনুঘটকের ভূমিকায় আছেন—ফিলিস্তিনিদের সংস্কারে, হামাসকে নিরস্ত্রীকরণে ও আরবদের স্থিতিশীলতা বাহিনী গঠনে প্রভাব রাখছেন।”

তবে অন্যদের মতে, প্রতীকী স্বীকৃতির বাইরে গাজা যুদ্ধ শেষ হলেও তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়।

আন্তর্জাতিক সংকট বিশ্লেষণ সংস্থার জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক আমজাদ ইরাকি বলেন, “ফ্রান্সের মতো বড় শক্তির স্বীকৃতি ইসরায়েলের অনড় অবস্থানের প্রতি ক্রমবর্ধমান হতাশা তুলে ধরে। কিন্তু যদি কিছুই করা না হয়, তাহলে স্বীকৃতিটা আদৌ কী কাজে লাগবে?”

ইসরায়েলের কূটনৈতিক চাপ সত্ত্বেও অটল ফ্রান্স:
ফরাসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসরায়েল মাসের পর মাস ফ্রান্সের এই পদক্ষেপ থামানোর চেষ্টা করেছে। এমনকি নেতানিয়াহু একাধিকবার এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন।

সূত্র জানায়, ইসরায়েল হুমকি দিয়েছিল—ফ্রান্সের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান কমিয়ে দেওয়া হতে পারে, এমনকি প্যারিসের মধ্যপ্রাচ্য উদ্যোগগুলো জটিল হয়ে উঠতে পারে।

তবে ফরাসি কর্মকর্তাদের ধারণা, নেতানিয়াহু তার স্বার্থেই পশ্চিমতীরের যেকোনো পদক্ষেপ নেবেন, ফ্রান্স কী করল তাতে তার খুব একটা পরিবর্তন হবে না।

বুধবার ইসরায়েলের পার্লামেন্ট একটি অননুসন্ধানযোগ্য প্রস্তাবে ভোট দিয়ে বলেছে, পশ্চিমতীরে ইসরায়েলি আইন প্রয়োগ করতে হবে—যা মূলত অঞ্চলটি দখলের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। এই পরিস্থিতিই প্যারিসকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ত্বরান্বিত করেছে।

এক শীর্ষ ফরাসি কর্মকর্তা বলেন, “ইতিহাসের নির্দিষ্ট এক মুহূর্তে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার, তা প্রতীকী হলেও। আমি বলব, সেই মুহূর্তটা এখন এসেছে।”

সূত্র: রয়টার্স।

মিরাজ খান

×