ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতা: সৌদিতে নতুন আলোয় বেদুইন তাঁবু

মোহাম্মদ সানাউল হক, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রিয়াদ

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ২২ জুলাই ২০২৫

ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতা: সৌদিতে নতুন আলোয় বেদুইন তাঁবু

ছবি: সংগৃহীত

সৌদি আরবজুড়ে নতুনভাবে জেগে উঠছে বেদুইন সংস্কৃতি, আর এই নবজাগরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী বেদুইন তাঁবু—যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত “বাইত আল-শাআর”, অর্থাৎ "চুলের ঘর"। উট, ছাগল ও ভেড়ার লোম দিয়ে তৈরি এই তাঁবুগুলো একসময় মরুভূমির যাযাবর জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। কিন্তু আজ তা শুধু অতীত নয়—এটি নতুন প্রজন্মের কাছে একটি সাংস্কৃতিক রত্ন হিসেবে পুনরাবিষ্কৃত হচ্ছে। 

এই তাঁবুগুলো বর্তমানে কেবল স্থানীয়দের পারিবারিক মিলনমেলা বা সামাজিক আয়োজনে নয়, বিদেশি পর্যটকদের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেক ভ্রমণকারীই সৌদি আরব সফরের সময় বেদুইন জীবনের স্বাদ নিতে চান। তাঁরা মরুভূমির গভীরে গিয়ে এক রাত এই ঐতিহ্যবাহী তাঁবুতে কাটিয়ে দেখেন কেমন ছিল যাযাবর জীবনের অভিজ্ঞতা।

ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক বেদুইন তাঁবু সৌদি সংস্কৃতির মূল শিকড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে শীত মৌসুমে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় আল-জউফ অঞ্চলে এসব তাঁবুর চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এই চাহিদার পেছনে কেবলমাত্র ঠান্ডা আবহাওয়ার প্রভাবই নয়, বরং রয়েছে একটি গভীর সাংস্কৃতিক অনুরণন। এই তাঁবুগুলোর মাধ্যমে অতীতের বেদুইন জীবনধারার প্রতি এক ধরনের নস্টালজিয়া ও সম্মানবোধ গড়ে উঠছে, যা আধুনিক সৌদি সমাজে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।

এই নবজাগরণ কেবল সৌদি নাগরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; আন্তর্জাতিক পর্যটকরাও এই বেদুইন অভিজ্ঞতার প্রতি বাড়তি আকৃষ্ট হচ্ছেন। তাঁবুতে রাত্রিযাপন, ঐতিহ্যবাহী খাবার, সঙ্গীত ও আতিথেয়তা উপভোগ করে পর্যটকেরা সৌদি আরবকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কার করছেন—যেখানে প্রাচীন সংস্কৃতি ও আধুনিক পর্যটনের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। তাই বলা যায়, বেদুইন তাঁবুগুলো আজ কেবল মরুভূমির আবাস নয়, বরং সৌদি আরবের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক জীবন্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে।

রাজা আবদুলআজিজ নারী উন্নয়ন সংস্থার বেদুইন তাঁবুবিষয়ক বিশেষজ্ঞ উম নাজেহ জানান, শীতকালে ঐতিহ্যবাহী বেদুইন তাঁবুর প্রতি আগ্রহ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এসব তাঁবু শুধুমাত্র প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীকই নয়, বরং মরুভূমির প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার এক অতুলনীয় উদাহরণ। শতভাগ হাতে তৈরি এই তাঁবুগুলোর কাপড় বোনা হয় উট, ছাগল ও ভেড়ার লোম একত্র করে তা সুতোয় রূপান্তরের মাধ্যমে। 

এছাড়াও, প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি হওয়ায় এগুলো শীতকালে তাপ ধরে রাখতে এবং গ্রীষ্মে ঠান্ডা পরিবেশ বজায় রাখতে সহায়তা করে। তীব্র রোদ, বালুঝড়, শৈত্যপ্রবাহ কিংবা বৃষ্টিপাত—সব ধরনের জলবায়ুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকার কারণেই এই তাঁবুগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মরুভূমির মানুষের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

এই তাঁবুর শিল্পকর্ম মূলত বেদুইন নারীদের হাতেই গড়ে ওঠে। তাঁরা প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তাঁরা সুতা তৈরি করতে চাকরি (spindle) ব্যবহার করেন, আঁশ পরিষ্কারে একটি লাঠি ব্যবহার করেন, সেলাইয়ের জন্য বিশাল আকৃতির সুচ, আর তাঁবু বেঁধে রাখার জন্য পাটের রশি ব্যবহার করেন। কিছু তাঁবু একটিমাত্র খুঁটির ওপর দাঁড় করানো হয়, আবার বড় তাঁবুগুলো ছয় বা ততোধিক খুঁটি দিয়ে তৈরি হয়।

এই তাঁবুগুলো শুধু ব্যবহারিক দিক থেকেই নয়, বরং এটি বেদুইন জাতিসত্তার গভীর সাংস্কৃতিক প্রতীক। এটি এমন একটি জীবনধারার অংশ, যা আরব উপদ্বীপের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বেদুইন তাঁবু একটি সময়ের গল্প, যেটি আজকের আধুনিক সৌদি আরবেও গর্বের সঙ্গে লালিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী টেকসই ও সাংস্কৃতিক পর্যটনের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌদি আরব এসব ঐতিহ্যবাহী তাঁবুকে পর্যটন পণ্যে রূপ দিচ্ছে। শুধু আশ্রয় নয়, বরং এটি এখন পর্যটকদের জন্য একটি জীবন্ত জাদুঘর—যেখানে তাঁরা মরুভূমির ইতিহাস ও জীবনধারা নিজের চোখে দেখতে ও উপভোগ করতে পারেন।

এই উদ্যোগের পেছনে রয়েছে সৌদি ভিশন ২০৩০—একটি উচ্চাভিলাষী রূপকল্প, যা দেশকে বৈচিত্র্যময় ও টেকসই অর্থনীতির পথে এগিয়ে নিতে চায়। এই ভিশনের অংশ হিসেবেই দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার কাজ চলছে। বেদুইন তাঁবু সেই উদ্যোগেরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আধুনিক সৌদিদের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ শুধু ইতিহাসের সংরক্ষণ নয়—এটি পর্যটন খাতে অর্থনৈতিক গতিশীলতারও অন্যতম চাবিকাঠি। উচ্চ পর্যায়ের ভ্রমণ সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে সৌদি আরবের এই বেদুইন অভিজ্ঞতাকে তাদের প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত করছে। এতে সৌদি পর্যটন একটি নতুন মাত্রা পাচ্ছে, যেখানে ঐতিহ্য ও বিলাসিতা একত্র হয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে।

এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরবে আবারও উজ্জীবিত হচ্ছে বেদুইন সংস্কৃতি। ঐতিহ্যবাহী তাঁবু নির্মাণের পাশাপাশি সামনে আসছে বেদুইন জীবনের আরও বহু চর্চা—যেমন কবিতা পাঠের আসর, মরুপ্রান্তরের জনপ্রিয় উট দৌড় এবং সামাজিক উৎসবগুলিতে আয়োজিত 'আরধা' নামের ঐতিহ্যবাহী তরবারি নৃত্য।

সৌদি আরবের নানা অঞ্চলে এখন আবারও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে সেইসব প্রাচীন রীতিনীতি ও ঐতিহ্য, যা একসময় কেবল ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছিল। এসব সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ একত্র হয়ে গড়ে তুলছে একটি আধুনিক হলেও গভীর ঐতিহ্যসম্পন্ন সমাজব্যবস্থা। সংস্কৃতির এই নবজাগরণ শুধু অতীতকে স্মরণ করার আয়োজন নয়, বরং তা নতুন প্রজন্মকে নিজ শেকড়ের সঙ্গে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, এক গর্বিত উত্তরাধিকার বহনের পথ তৈরি করছে।

আজকের সৌদি আরবে বেদুইন সংস্কৃতি শুধুমাত্র অতীত স্মরণ নয়, এটি এক গর্বিত উত্তরাধিকারকে উদ্‌যাপন করার মাধ্যম। সময়ের প্রবাহে অনেক কিছু বদলে গেলেও, বেদুইনদের জীবনধারা, অতিথিপরায়ণতা, এবং মরুভূমিভিত্তিক সংস্কৃতি এখনও মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

বিশেষ করে বাইত আল-শাআর তাঁবুগুলোর গুরুত্ব এখন নতুনভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যটনে এই তাঁবুগুলোর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। এর মাধ্যমে মরুভূমির আত্মা ও সৌদি আরবের ঐতিহ্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে—যা দেশের আত্মপরিচয়কে বিশ্বমঞ্চে নতুনভাবে তুলে ধরার এক সার্থক প্রয়াস।

আবির

×