
কুমিল্লা নগরীর হৃদয়ে অবস্থিত ধর্মসাগর শুধু একটি দীঘি নয়, এটি এক ইতিহাসের দলিল, এক রাজকীয় উত্তরাধিকার। প্রায় ৫ শতাব্দী আগের এই জলাধার আজও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে, তবে তার পরিচর্যা ও গুরুত্বে ঘাটতি যেন চোখে পড়ে প্রতিটি সচেতন নাগরিকের।
ত্রিপুরার অধিপতি মহারাজ ধর্মমাণিক্য ১৪৫৮ সালে কুমিল্লা ও আশপাশের জনপদের মানুষের পানীয় জলের চাহিদা পূরণে এই বিশাল দীঘি খনন করেন। রাজমালা গ্রন্থ ও তাম্রলিপির তথ্য অনুযায়ী, চন্দ্রবংশীয় এই রাজা দীর্ঘ ৩২ বছর রাজত্ব করেন (১৪৩১–১৪৬২ খ্রি.)। ধর্মসাগরের নামকরণও হয়েছে তাঁর নাম অনুসারেই।
১৯৬৪ সালে দীঘিটির উত্তর ও পশ্চিম পাড় পাকা করা হলেও বর্তমানে এর বেশিরভাগ অংশই এখনো কাঁচা। যদিও দীঘির আশেপাশে কুমিল্লা স্টেডিয়াম, জিলা স্কুল, পৌর পার্ক, সিটি কর্পোরেশন উদ্যান ও ডিসি অফিস থাকায় এর গুরুত্ব বহুগুণে বেড়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের অভাবে পুরো ধর্মসাগর এলাকাটি আজও তার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না।
সাগর পাড়ের পশ্চিমাংশে কিছু বসার স্থান থাকলেও পূর্ব ও দক্ষিণাংশে এখনো নেই নান্দনিক ওয়াকওয়ে বা পর্যাপ্ত আলোকসজ্জা। অথচ প্রতিদিন শত শত মানুষ এখানে আসেন—কারো কাছে এটি প্রাতঃভ্রমণের প্রিয় জায়গা, কারো কাছে পারিবারিক অবকাশের স্থান, আবার কারো কাছে সংস্কৃতি চর্চার খোলা মঞ্চ। শীতকালে এখানে ভিড় করে অতিথি পাখি, আর বছরের প্রতিটি দিনই থাকে পর্যটকের পদচারণা।
এদিকে ধর্মসাগরের একপাশে ময়লা আবর্জনার জমা, কচুরিপানার আধিক্য এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব জনমনে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “ধর্মসাগরের চারপাশ যদি পুরোপুরি পাকা করে দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে, আলোকসজ্জা, পরিচ্ছন্ন টয়লেট ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে এটি হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ।”
বিশিষ্টজনেরা বলছেন, ধর্মসাগরের পরিবেশ রক্ষায় শুধু প্রশাসনিক উদ্যোগই নয়, প্রয়োজন জনসচেতনতাও। কুমিল্লাবাসীর এ গর্বিত ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
ধর্মসাগরের সবুজ বৃক্ষের সারি, অতিথি পাখির কলরব, এবং ইতিহাসের অনুরণন মিলে এটি শুধু কুমিল্লার নয়, বরং বাংলাদেশেরই একটি মূল্যবান সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য।
একটি পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও আধুনিক ধর্মসাগর চাই — এ চাওয়া আজ সব কুমিল্লাবাসীর।
Jahan