
ছবি: সংগৃহীত
জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অগ্রদূত মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। প্রথম বাংলায় আকাশের তারাসমূহের ছক তৈরি করা জ্যোতির্বিজ্ঞানী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার ১৯১৫ সালের ১লা জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর থানার গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৩ সালের ২০ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও পরিকল্পনায়ই বাংলাদেশের প্রথম খ-গোলক নির্মিত হয়। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
১৯৩৮ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিশুদ্ধ গণিতে অনার্সসহ এম.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন। এরপর ১৯৩৯ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে লন্ডন যান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তাকে ভারত সরকারের নির্দেশেই ফিরে আসতে হয়। দেশে ফিরে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে চাকরি করেন। এরপর যোগ দেন চট্টগ্রাম কলেজে এবং সেখান থেকে চলে যান প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর আবদুল জব্বারের চাকরি জীবন ছিল বড় কঠিন। ১৯৪৮ সালে তিনি তৎকালীন ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি এই বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। সেই বছরই আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে তিনি এর রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন এবং ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রকল্যাণ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. এম. এ. রশীদের নামে সম্মানসূচক পদ (চেয়ার)-এর সূচনা করা হয়। মোহাম্মদ আবদুল জব্বার প্রথমবারের মতো 'ড. রশীদ অধ্যাপক' নিযুক্ত হয়ে পুনরায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।
দুই বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে আবদুল জব্বার ছিলেন সবার ছোট। তার পিতা মিয়াজান মল্লিক প্রথম জীবনে মাঝি ছিলেন। পরবর্তীতে ছোট ব্যবসা শুরু করেন এবং এই ব্যবসার আয় দিয়েই সংসার চালাতেন তিনি। মিয়াজান মল্লিক তার বড় ছেলে মোহাম্মদ আবিদ আলীকে প্রথমে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করান। পাঠশালার হেডপণ্ডিত শশী ভূষণ দাস মেধাবী আবিদ আলীকে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেন। বৃত্তি পরীক্ষায় আবিদ আলী জেলার সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হয়ে মাসিক দুই টাকা বৃত্তি লাভ করেন এবং স্কুলে বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ পান। ছাত্রজীবনে আবদুল জব্বার এবং তার মেজো ভাই আকবর আলীকে হেডপণ্ডিত পাঠশালায় বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ দেন। অদম্য মেধাবী আবদুল জব্বার ১৯৩২ সালে সুজানগরের সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে লেটারসহ ম্যাট্রিক পাস করেন। একই বছর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আই.এস.সি. ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে তিনি এই কলেজ থেকে গণিতে লেটারসহ কৃতিত্বের সঙ্গে আই.এস.সি. পাস করেন। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মুসলমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং বৃত্তি লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনিযুক্ত জার্মান অধ্যাপক এফ.ডব্লিউ.লেভি এম.এস.সি. শ্রেণিতে মডার্ন অ্যালজেবরা নামে একটি নতুন বিষয় প্রবর্তন করেন। এই নতুন বিষয়ের একমাত্র ছাত্র ছিলেন আবদুল জব্বার। ১৯৩৮ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের লন্ডনে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপকের অধীনে পড়াশোনা শুরু করেন। যুদ্ধকালীন নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এক বছর গবেষণা করে তিনি যখন পিএইচডি ডিগ্রির জন্য মনোনীত হন, এসময় ব্রিটিশ সরকার সব বিদেশীকে ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যাবার আদেশ জারি করলে আবদুল জব্বার তার উচ্চশিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। দারিদ্র্য মাঝির মেধাবী সন্তান বৃত্তি আর স্কলারশিপে শিক্ষা জীবন শেষ করেন। বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ এবং উপকরণ তিনিই প্রথম সৃষ্টি করেন। ১৯৬২-৮২ সাল পর্যন্ত তার অঙ্কিত তারা চিত্র 'রাতের আকাশ' নামে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তার সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং পরিকল্পনায় বাংলাদেশের প্রথম খ-গোলক (celestial globe) নির্মিত হয়। এই খ-গোলকটি বর্তমানে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে সংরক্ষিত আছে।
কর্মজীবনে তিনি পুরস্কার ও সম্মাননা হিসাবে অর্জন করেন: ১৯৬৫ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক) সাহিত্য পুরস্কার; ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন; ১৯৮৫ সালে ড. কুদরত-ই-খুদা স্মৃতি পদক; ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার; ১৯৮৫ সালে একুশে পদক। কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, অনুসন্ধিৎসু চক্র ও বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে তাকে ১৯৯০ সালে ব্রুনো পদকে ভূষিত করে। তার রচনাবলীগুলো হলো: ১৯৪২ সালে রচনা করেন 'বিশ্ব রহস্যে নিউটন ও আইনস্টাইন'; ১৯৬৫ সালে 'খগোল পরিচয়'; ১৯৬৭ সালে 'তারা পরিচিতি'; ১৯৭৩ সালে 'প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা'; ১৯৮৬ সালে 'বিশ্ব ও সৌরজগৎ'; ১৯৮৯ সালে 'আকাশ পট'। তিনি আরও রচনা করেন: 'টেক্সট বুক অব ইন্টারমিডিয়েট স্টাটিসটিক্স', 'টেক্সট বুক অব ইন্টারমিডিয়েট ডাইনামিক্স', 'টেক্সট বুক অব ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস', 'টেক্সট বুক অব ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস'।
লেখকঃ হৃদয় হোসাইন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পাবনা
সাব্বির