
দৈনিক জনকণ্ঠ
একটা সময় ছিল, যখন পুরান ঢাকার অলিগলিতে ঘোড়ার গাড়ির খটখট আওয়াজ শুনেই সকাল শুরু করত শহরের মানুষ। চকবাজার থেকে বাংলাবাজার, ইসলামপুর থেকে নবাববাড়ি— শহরের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে দেখা যেত একেকটা এক্কা গাড়ি, ঝকমকে সজ্জিত, ছাদে রঙিন চাঁদোয়া, আর পাশে কাঁচা ছালার লাগাম টেনে বসে থাকতেন গর্বিত ঘোড়সওয়ার।
আজ সেই গাড়ির আওয়াজ নেই, নেই ঘোড়ার টগবগ ছুট, নাই যাত্রীর কোলাহল। সময়ের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে হারিয়ে গেছে এক ঐতিহ্য— নাম তার ঘোড়ার গাড়ি।
একটা সময় ছিল যখন এই বাহনে চড়া মানে ছিল "অভিজাত শ্রেণির" চিহ্ন। নবাবদের গাড়ি ছিল রুপালি চাকায়, ব্যবসায়ীদের গাড়িতে থাকত পিতলের ঘণ্টা। বিয়ে, ইদ, রাজনৈতিক মিছিল— সবক্ষেত্রেই থাকত ঘোড়ার গাড়ি। আজকের প্রজন্ম হয়ত বিশ্বাসই করতে পারবে না, ঢাকার শহরে এমন বাহনও একদিন ছিল।
“ঘোড়াটা ছিল আমার পরিবারের মতো”
৭০ বছরের আব্দুল গফুর এখন বসে থাকেন নবাবপুরের এক কোণে। মুখে স্মৃতির ছায়া। “আমার বাবাও চালাত ঘোড়ার গাড়ি। স্কুলছাত্রদের, বাবুদের, বিয়ের শোভাযাত্রা— কত মানুষ যে উঠেছে আমার গাড়িতে! এখন তো আমার ঘোড়াটাও নেই, আমিও নেই কাজের ভিতরে।”
গফুরের গলা ভারি হয়ে আসে। “ঘোড়াটা অসুস্থ হয়েছিল। চিকিৎসা করাতে পারিনি। একদিন চুপচাপ চলে গেল... এরপর আমি আর গাড়িতে হাত দিইনি।”
কেন হারিয়ে গেল?
বিলুপ্তির কারণ অনেক।
রাস্তার সংকীর্ণতা ও যানজট
আধুনিক বাহনের দখলদারি
ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধি কৌতূহলের অভাব ও সংস্কৃতির অবহেলা
সব মিলিয়ে, ঘোড়ার গাড়ি হয়ে পড়ে ‘অপ্রয়োজনীয়’।
বর্তমানে ২–৩টি ঘোড়ার গাড়ি আছে, যারা মাঝে মাঝে বিবাহ অনুষ্ঠানে অথবা সিনেমার দৃশ্যে ভাড়া হয়। তাও লোক-দেখানো নস্টালজিয়া। শহরের কেউ আর এই বাহনকে বাহন মনে করে না, শুধুই বিনোদন!
ঘোড়ার গাড়ির হারিয়ে যাওয়া মানে শুধুই এক বাহনের বিদায় নয়— এটা একটা শহরের নীরব ইতিহাস, একনের শব্দ, ঘামের গন্ধ, ধুলায় ভেজা এক জীবনের গল্পের চুপ করে চলে যাওয়া।
পুরান ঢাকার অলিগলিতে আর সেই খটখটে শব্দ ওঠে না, আর কেউ বলে না,
"এইযে বাবু, উঠবেন? চকবাজার পর্যন্ত চলি?”
হ্যাপী