ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে শোকাহত পুরো জাতি, ট্রমা কাটিয়ে উঠতে যা করবেন

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১১:২৬, ২২ জুলাই ২০২৫

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে শোকাহত পুরো জাতি, ট্রমা কাটিয়ে উঠতে যা করবেন

ছ‌বি: সংগৃহীত

রাজধানীর দিয়াবাড়িতে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। যাদের মধ্যে ২৫ জনই শিশু শিক্ষার্থী। বাকিরা হলেন একজন শিক্ষিকা এবং দুর্ঘটনাকবলিত বিমানের পাইলট। এই ঘটনা পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, প্রশাসন সবাই এক ধরনের শোক ও মানসিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন ৭৮ জন। এদের মধ্যে অনেকেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অনেক শিশুর শরীরে মারাত্মক বার্ন ইনজুরি রয়েছে, যাদের সুস্থ হয়ে উঠতে লম্বা সময় লাগবে।

এমন ঘটনা দেশের ইতিহাসে বিরল। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এভাবে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এতো বড় প্রাণহানি কখনোই প্রত্যক্ষ করেনি এই জাতি। যারা এ ঘটনায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের জন্য মানসিক আঘাতের মাত্রা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। স্কুলের বন্ধু, সহপাঠী, শিক্ষক হারানো শিশুগুলোর মনের ভেতরে যে ধাক্কা লেগেছে, তা তারা হয়তো দীর্ঘদিন ভুলতে পারবে না। একইসাথে যারা আহত হয়েছে, তারা শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

অভিভাবকদের জন্যও এটি এক অসহনীয় সময়। যারা সন্তান হারিয়েছেন, তারা এখন শোকের সাগরে ভাসছেন। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কখনোই মুছে ফেলা যায় না। যারা সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন, তারা দুঃশ্চিন্তায় ঘুম হারিয়ে ফেলেছেন। এসব পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? কীভাবে এই ট্রমা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসা সম্ভব? এমন সময় নিজের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করাও একটি চ্যালেঞ্জ।

প্রথমেই প্রয়োজন আত্মসমর্থন। কেউ যদি প্রিয়জন হারায়, কিংবা কারো কাছের কেউ দুর্ঘটনায় পড়েন, তখন প্রথম ধাক্কাটা সামাল দিতে কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকেই এই সময়ে নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে, ‘আমি কেন ওকে যেতে দিলাম’, ‘আরেকটু আগে-বরে পাঠালে হয়তো বাঁচত’। এসব চিন্তা স্বাভাবিক, কিন্তু বাস্তবে এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। দুর্ঘটনার দায় কারো নয়। একে ‘ভাগ্য’ বা ‘দৈব ঘটনা’ হিসেবেই মেনে নিতে হবে।

এছাড়া পরিবার-পরিজনের পাশে থাকা জরুরি। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের একা রাখা যাবে না। সন্তান হারানো মা-বাবা, অথবা আহত শিশুর পরিবার—সবাইকে সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলা, সময় দেওয়া, পাশে দাঁড়ানো খুব দরকার। অনেক সময় চুপচাপ পাশে বসে থাকাটাও একটা বড় সহানুভূতি হয়ে দাঁড়ায়।

এই ঘটনায় যারা বেঁচে আছে, কিন্তু চোখের সামনে ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছে, তাদের জন্য মানসিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা এমন ঘটনার পর মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ট্রমায় ভুগতে পারে। তারা রাতে ঘুমাতে ভয় পেতে পারে, স্কুলে যেতে চাইবে না, কথাবার্তা কমিয়ে দেবে, আঁকতে বসলে হয়তো আগুন বা মৃত্যু আঁকবে। এসব লক্ষণ দেখা গেলে অবহেলা করা যাবে না। সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং খুব জরুরি। অভিভাবকরা চাইলে মনোবিজ্ঞানী বা চাইল্ড কাউন্সেলরের সাহায্য নিতে পারেন।

শিক্ষকদের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলে ফিরে আসার পর শিক্ষার্থীরা যেন নিজেদের একা মনে না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শিশুকে বলার সুযোগ দিতে হবে সে কী দেখেছে, কী অনুভব করেছে। যারা কাঁদতে চায়, কাঁদতে দিতে হবে। যারা চুপ করে থাকে, তাদের ধৈর্য ধরে কাছে টানতে হবে। কাউকে জোর করে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক নয়।

ট্রমা কাটাতে নিয়মিত রুটিনে ফিরে আসা জরুরি। ধীরে ধীরে আবার স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলা করা, ঘুম ঠিক করা, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো— এসব কাজে মনোযোগ দিলে ট্রমা কিছুটা হলেও হালকা হয়। পরিবারেও নিয়মিত রুটিন চালু রাখতে হবে। একে অপরকে সময় দেওয়া, একসাথে খাওয়া, গল্প করা এগুলো মানসিক শক্তি বাড়ায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং টিভিতে দুর্ঘটনার ছবি বা ভিডিও দেখে শিশুরা আবার ট্রমায় চলে যেতে পারে। তাই অভিভাবকদের দায়িত্ব হবে এমন কনটেন্ট থেকে সন্তানকে দূরে রাখা। নিজেদের জন্যও এই সীমাবদ্ধতা রাখা ভালো, কারণ অনেক সময় বারবার ওই দৃশ্য দেখলে মস্তিষ্কে ক্ষত তৈরি হয়।

সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে আশা না হারানো। যে শিশু এখন হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে, সে আবার সুস্থ হয়ে ফিরবে— এই বিশ্বাস থাকতে হবে। চিকিৎসকেরা দিনরাত কাজ করছেন তাদের সুস্থ করে তুলতে। রাষ্ট্র থেকেও সহযোগিতার আশ্বাস এসেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যেন আর্থিক ও মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে, সে দায়িত্ব সরকারকেও নিতে হবে।

শেষ পর্যন্ত আমাদের সবাইকে এই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। যেন আর কোনো স্কুলে, আর কোনো শিশুর ক্লাসরুমে এমন মৃত্যু না ঘটে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কড়াকড়ি করতে হবে, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম যেন জনবহুল এলাকায় না হয়, সেই বিষয়েও প্রশাসনকে ভাবতে হবে।

এই ভয়াবহ ঘটনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। আমরা হারিয়েছি অনেক তাজা প্রাণ, কিন্তু এখনো সময় আছে নিজেদের ঠিক করে নেওয়ার। যারা বেঁচে আছে, তাদের জন্য ভালোবাসা, যত্ন ও সাহচর্য খুব জরুরি। আর যারা চলে গেছে, তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে আমরা সবাই যেন একসাথে এই দুঃসময় পার করতে পারি— এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

এম.কে.

×