
ছবি: প্রতীকী
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মধ্যে ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি মাধ্যম, যেখানে মানুষ নানা খবর, ছবি, ভিডিও এবং মতামত শেয়ার করে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ফেসবুকে ভয়াবহ, রক্তাক্ত এবং মর্মান্তিক ঘটনার ছবি ও ভিডিওর ছড়াছড়ি বেড়ে গেছে। দুর্ঘটনা, হত্যা, আত্মহত্যা কিংবা সহিংসতার দৃশ্য অনেকেই বিনা চিন্তাভাবনায় শেয়ার করছে। এমনকি অনেক সময় কোনো রকম সতর্কতা বা ব্যাখ্যা ছাড়াই এসব ছবি সামনে চলে আসে। এতে করে ব্যবহারকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে, বিশেষ করে শিশু, কিশোর ও মানসিকভাবে সংবেদনশীল মানুষদের ওপর।
একটি ছোট শিশুও আজকাল ফেসবুকে ঢুকে পড়ছে অভিভাবকের অজান্তেই। সে যখন হঠাৎ করে রক্তাক্ত লাশ বা কাটা-ছেঁড়া দেহের ছবি দেখে, তখন তার মনে যে ধাক্কা লাগে তা অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার কিশোর-কিশোরীরা যাদের আবেগ অনিয়ন্ত্রিত, তারাও এসব দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অনেক সময় কেউ কেউ অবচেতনে এসব ঘটনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং তা অনুকরণ করার ঝুঁকিও তৈরি হয়।
শুধু কম বয়সীরা নয়, প্রাপ্তবয়স্করাও এসব দৃশ্য দেখে আতঙ্ক, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতায় ভোগে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কেউ ফেসবুক খুলেই যদি দেখে এক মায়ের কান্না, একটি শিশুর রক্তাক্ত মুখ, কিংবা রাস্তায় পিষে যাওয়া কোনো দেহ, তাহলে সেই দিনের মানসিক অবস্থাই নষ্ট হয়ে যায়। এই দৃশ্যগুলো একবার দেখলেই মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। অনেক সময় রাতে ঘুম নষ্ট হয়, দুঃস্বপ্নে ভোগে মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরণের মানসিক চাপ ধীরে ধীরে ডিপ্রেশন, এংজাইটি ও মানসিক ভারসাম্যহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেকেই ফেসবুকে এসব ছবি দিয়ে "দেখুন কতটা নিষ্ঠুর ঘটনা", "মানবতা কোথায়?", বা "শেয়ার দিন সবাই জানুক" – এমন ক্যাপশন দেয়। এতে করে এসব কনটেন্ট আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং আরও বেশি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। মানুষের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা থাকলেও ফল হয় উল্টো। কেউ কেউ এগুলো দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, আবার কেউ কেউ নিজের অজান্তেই আসক্ত হয়ে পড়ে এইসব বীভৎস কনটেন্ট দেখার প্রতি।
বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, কেউ একজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের মানুষ মোবাইল বের করে ছবি তোলে এবং তা ফেসবুকে আপলোড করে দেয়। অথচ সে আহত মানুষটিকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা ভাবে না। যেন একটি ছবি বা ভিডিও ভাইরাল করাই এখন সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে করে আমাদের মানবিকতা, সহমর্মিতা ও সামাজিক মূল্যবোধও ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কিছু নিয়ম-কানুন চালু করলেও তা খুব কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয় না। ফেসবুকের অ্যালগরিদম অনেক সময় বুঝতে পারে না কোন ছবি সহিংস এবং কার মানসিক ক্ষতি করতে পারে। ফলে ব্যবহারকারীরাই যদি সচেতন না হয়, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।
এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন গণসচেতনতা। আমাদের বুঝতে হবে যে প্রতিটি ছবি বা ভিডিও শেয়ারের আগে ভাবতে হবে – এটি কারও জন্য মানসিক যন্ত্রণার কারণ হতে পারে কি না। কেউ হয়তো একটি ছবিতে তার প্রিয়জনকে মৃত অবস্থায় দেখে ফেলল, যা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রমা হয়ে থাকবে। তাই উচিত, যে কোনো ধরনের বীভৎস ছবি শেয়ারের আগে আত্মনিয়ন্ত্রণ করা এবং রিপোর্ট অপশন ব্যবহার করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে জানানো।
পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকেও এ বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে। শিশু-কিশোরদের বুঝাতে হবে কোন কনটেন্ট দেখা উচিত আর কোনটা নয়। প্রয়োজন হলে পিতামাতাকে ফেসবুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরণের ছবি ও ভিডিও থেকে দূরে থাকলে মন ভালো থাকে, একঘেয়েমি কমে এবং সমাজে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।
ফেসবুক একটি শক্তিশালী মাধ্যম। চাইলে তা হতে পারে ভালো খবর ছড়ানোর, মানবিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার এবং মানুষকে একত্রিত করার ক্ষেত্র। কিন্তু এর অপব্যবহার যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে ফেসবুকই হয়ে উঠবে মানসিক বিপর্যয়ের কারণ। তাই এখনই সময় নিজেদের ব্যবহারবিধি পর্যালোচনা করার এবং মানবিকভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার।
এম.কে.