ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

পানি কম খাওয়ার ভয়াবহ ৯টি লক্ষণ

প্রকাশিত: ১৬:০৯, ২৩ জুলাই ২০২৫

পানি কম খাওয়ার ভয়াবহ ৯টি লক্ষণ

ছবি: সংগৃহীত

মানবদেহের প্রায় ৬০% অংশই পানি দিয়ে গঠিত। এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, হজমে সহায়তা করে এবং জয়েন্ট বা সন্ধিগুলোকে সুরক্ষা দেয়। সহজভাবে বললে—পানি ছাড়া শরীরের কোনো ব্যবস্থাই ঠিকমতো চলে না।

তারপরও প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ না জেনেই সামান্য পানিশূন্য অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। চরম ডিহাইড্রেশনকে আমরা গুরুত্ব দিলেও, মাঝারি বা হালকা পানিশূন্যতার লক্ষণগুলো প্রায়ই আমরা উপেক্ষা করি—যেমন অতিরিক্ত ক্লান্তি, মনোযোগের অভাব বা আচমকা মিষ্টি খাওয়ার প্রবণতা।

এই লক্ষণগুলো দ্রুত চিনে ফেলা গেলে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। নিচে শরীরের এমন ৯টি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া হলো, যেগুলো বলছে—আপনার শরীর আরও বেশি পানি চাচ্ছে।

১. মুখ শুকিয়ে যাওয়া বা দুর্গন্ধ হওয়া

মুখে শুকনো বা আঠালো অনুভূতি কেবল অস্বস্তিকরই নয়, বরং এটি পানিশূন্যতার সবচেয়ে প্রাথমিক লক্ষণ। লালারস শুধু মুখকে স্যাঁতসেঁতে রাখে না, এটি মুখের ব্যাকটেরিয়াও নিয়ন্ত্রণ করে। পর্যাপ্ত পানি না পেলে লালারস উৎপাদন কমে যায়, ফলে মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া বেড়ে যায়।

মায়ো ক্লিনিক বলছে—লালারসের ঘাটতি, যা মূলত পানিশূন্যতার কারণে ঘটে, তা দীর্ঘস্থায়ী মুখের দুর্গন্ধের (হ্যালিটোসিস) প্রধান কারণ।

২. প্রস্রাব গাঢ় হলুদ বা গন্ধযুক্ত হওয়া

আপনার প্রস্রাবের রং ও গন্ধ থেকে হাইড্রেশন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। আদর্শভাবে, প্রস্রাব হওয়া উচিত ফ্যাকাসে হলুদ বা প্রায় স্বচ্ছ। যদি গাঢ় হলুদ, ঘন বা তীব্র গন্ধযুক্ত হয়, তাহলে বুঝতে হবে শরীর পানি ধরে রাখছে।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক জানিয়েছে—ডার্ক রঙের প্রস্রাব, বিশেষ করে কম বার প্রস্রাব হওয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকলে, এটি পানিশূন্যতার পরিষ্কার লক্ষণ। দীর্ঘমেয়াদি ডিহাইড্রেশন কিডনি স্টোন এবং ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ঝুঁকিও বাড়ায়।

৩. মাথাব্যথা বা মাথা ঝিমঝিম করা

ডিহাইড্রেশনে রক্তের পরিমাণ কমে যায়, ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন পৌঁছাতে সমস্যা হয়—এতে মাথাব্যথা বা মাইগ্রেন হতে পারে। পাশাপাশি, শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যার ফলে মাথা ঘোরা বা ভারমুক্ত অনুভূতি হতে পারে।

নিউট্রিশন রিভিউস (২০১০) জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়—ডিহাইড্রেশন সরাসরি স্নায়বিক প্রভাব ফেলতে পারে, যার মধ্যে মাথাব্যথা ও মনঃসংযোগের অভাব অন্যতম।

৪. ত্বক শুকিয়ে যাওয়া বা খসখসে হয়ে ওঠা

শুকনো ত্বককে আমরা অনেক সময় আবহাওয়ার দোষ দিই, তবে এটি শরীরের ভেতরের পানির ঘাটতির লক্ষণও হতে পারে। পানি ত্বকের নমনীয়তা ও মসৃণতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। পানি কম হলে ত্বক হয়ে উঠতে পারে রুক্ষ, চুলকানিযুক্ত বা খসখসে।

ব্রিটিশ জার্নাল অফ ডার্মাটোলজি অনুসারে, পর্যাপ্ত পানি শরীরের ত্বক পুরু ও সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে, ফলে ত্বকে দৃশ্যমান শুষ্কতা কমে।

৫. কোষ্ঠকাঠিন্য

পানি হজমের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি অন্ত্রে বর্জ্য পদার্থ সরাতে সাহায্য করে। শরীরে পানি কমে গেলে কোলন মল থেকে অতিরিক্ত পানি শুষে নেয়, ফলে মল শক্ত ও কঠিন হয়ে যায়—যা বের করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (NIH) জানায়—ধারাবাহিক কোষ্ঠকাঠিন্য নিরসনে পানি খাওয়া বাড়ানোই প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত।

৬. ক্লান্তি বা মন খারাপ

যথেষ্ট ঘুমের পরও যদি নিজেকে ক্লান্ত, অলস বা অমনোযোগী মনে হয়, তাহলে এর কারণ আপনার ব্যস্ততা নয়—হতে পারে পানি কম খাওয়া। পানি শরীরে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখে এবং অক্সিজেন পরিবহন করে।

কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, ১–২% হালকা ডিহাইড্রেশনও নারীদের মধ্যে শক্তি কমে যাওয়া ও মন-মেজাজ খারাপের কারণ হতে পারে।

৭. হঠাৎ মিষ্টি খেতে ইচ্ছা

মিষ্টি খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সবসময় ক্ষুধা নয়—অনেক সময় এটি পানির ঘাটতির সংকেত। ডিহাইড্রেশনে যকৃত থেকে গ্লাইকোজেন তৈরি কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে শরীর দ্রুত জ্বালানি চায়—যার ফলে মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার ইচ্ছে হয়।

২০১৬ সালের ‘ফিজিওলজি অ্যান্ড বিহেভিয়ারে’ প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়—পানিশূন্যতা খাওয়ার আচরণ ও বিপাকীয় সংকেত প্রভাবিত করতে পারে, ফলে চিনি খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে।

৮. মনোযোগের অভাব বা ‘ব্রেইন ফগ’

মস্তিষ্ক প্রায় ৭৫% পানি দিয়ে গঠিত এবং এর সঠিক কার্যকারিতার জন্য হাইড্রেশন অপরিহার্য। হালকা ডিহাইড্রেশনেও মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি ও সতর্কতা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়।

আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিকাল নিউট্রিশন (২০১১) অনুযায়ী, হালকা পানিশূন্যতা কর্মস্মৃতি দুর্বল করে এবং উদ্বেগ ও ক্লান্তি বাড়ায়।

৯. পেশি টান বা জয়েন্টে ব্যথা

পানি জয়েন্ট ও পেশি ঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। শরীরে পানি কমে গেলে ব্যায়াম বা গরম আবহাওয়ার পর পেশিতে টান, ব্যথা বা খিঁচুনি দেখা দিতে পারে।

হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং জানায়—পর্যাপ্ত পানি ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখে, যা পেশির সংকোচন ও স্বাভাবিক কার্যকারিতায় সহায়ক।

এই লক্ষণগুলোর কোনোটি যদি আপনার মধ্যে দেখা যায়, তবে তা উপেক্ষা না করে এখনই পানি পান বাড়ান। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন গড়ে ২–৩ লিটার (৮–১২ গ্লাস) পানি পান করা উচিত—বিশেষত যদি আপনি শরীরচর্চা করেন বা গরম আবহাওয়ায় থাকেন।

সহজে পানি খাওয়ার কিছু উপায়:

  • প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানি পান করুন

  • প্রতি কয়েক ঘণ্টা পর ফোনে রিমাইন্ডার সেট করুন

  • বোতলে পানি মাপ দিয়ে রাখুন এবং পর্যবেক্ষণ করুন

  • পানিতে লেবু, পুদিনা বা শসা দিয়ে স্বাদ বাড়ান

  • তরমুজ, শসা, কমলা, টমেটোর মতো পানিযুক্ত খাবার খান

আবির

×