
বাঙালি সমাজে এক সময় প্রচলন ছিল যে,একটি রেডিও বা টেপ রেকর্ডার যৌতুক না দেয়ার কারণে ভেঙ্গে যেত একাধিক বিয়ে! আবার কোনো ব্যক্তি বিয়েতে রেডিও বা টেপ রেকর্ডার উপহার পেলে আশ পাশের গ্রাম থেকে সেটি দেখতে অনেকে ছুটে আসত। আবার পড়ন্ত বিকেল কিংবা রাতে বাড়ির উঠোনে টেপ রেকর্ডার বাজিয়ে সকলে একত্রিতভাবে গান, অনুষ্ঠান কিংবা খবর শুনত।
প্রতি রাতেই গ্রামে টেপ রেকর্ডারের মাধ্যমে গানের আসর বসত। বসবে নাই-বা কেন? তখনকার সময়ে গ্রামের মানুষের তথ্য প্রবাহ ও বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই রেডিও এবং টেপ রেকর্ডার। এমনকি মুক্তিযোদ্ধেও বিশাল অবদান রেখেছে এটি। কিন্তু আজ আর সেই রেডিও বা টেপ রেকর্ডার দেখা যায় না।
তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় কম্পিউটার, মোবাইল ও ইন্টারনেটের ভিড়ে হারিয়ে গেছে এসব যন্ত্র। মোবাইল, ইন্টারনেট কম্পিউটারে দক্ষ বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো রেডিও-টেপ রেকর্ডার চোখেও দেখেনি। ডিজিটাল যুগের ছোঁয়া পড়তে না পড়তে দ্রুত এগুলো হারিয়ে গেছে। জনগণের চাহিদা নেই বলে বাজারে পাওয়াও যায় না মান্ধাতার আমলের এই যন্ত্রগুলো।
মূলত, বাংলাদেশে অতীত বিনোদনের ডিজিটাল মাধ্যম বলতে ছিল- রেডিও-টেপ রেকর্ডার, টেলিভিশন ও সিনেমা। কিন্তু অসচ্ছল গ্রামীণ সমাজে সকলেরই টেলিভিশন কেনা সাধ্যের বাইরে ছিল। তাই সামান্য সচ্ছল পরিবারগুলো রেডিও-টেপ রেকর্ডার কিনতো বিনোদন উপভোগ ও খবর শোনার জন্য।
মো. মুরাদ হোসেন নামে বিকাশের এক কর্মকর্তা বলেন, "আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের একটি টেপ রেকর্ডার ছিল। আব্বা বাজার থেকে ‘অরুণ-বরুণ কিরণমালা’, ‘রূপবান’, ‘ঝিনুকমালা’, ‘শঙ্খমালা’, আপন-দুলালের কিচ্ছা’ বিভিন্ন সিনেমার গান সহ যাত্রাপালার অডিও রেকর্ড নিয়ে আসতেন। আমরা সবাই মিলে শুনতাম। রাতে কানের কাছে রেডিও নিয়ে শুনতাম দুর্বার । কিন্তু এখন কই সেই টেপ রেকর্ডার কই রেডিও? নেই, এখন আর নেই।"
উত্তরার বাসিন্দা মো. সালেহ আহমেদ বলেন,"একটা সময় ছিল, যখন দল বেঁধে সন্ধ্যার পর রেডিও-টেপ রেকর্ডারে অনুষ্ঠান উপভোগ করতাম। কিন্তু এখন আর দল বেঁধে গান, নাটক বা খবর শোনার জন্য কেউ অপেক্ষা করে না। এসব জায়গায় এখন দখল করে নিয়েছে ডিশ সংযোগে টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন।"
তিনি আরও বলেন, "শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক সবার হাতে এখন ভালো মানের মোবাইল ফোন আছে। যেখান থেকে তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো অনুষ্ঠান শুনতে পারে এবং দেখতেও পারে।"
একই এলাকায় ঔষধ ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান বলেন, "বেশি দিন আগের কথা না, কয়েক বছর আগেও যে দোকানে রেডিও, টেপ বা টিভি ছিল সে দোকানগুলোতে বেশি বেচা-বিক্রি হতো। কিন্তু এখন পল্লী অঞ্চলে বিশেষ কিছু দোকান ছাড়া আর কেউ দোকানে (বিশেষ করে চা স্টল বা খাবার হোটেল) রেডিও-টিভি দেখার জন্য আসে না। প্রত্যেক ঘরে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল আছে।"
একই এলাকার বৃদ্ধ ফজল মিয়া বলেন,"আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের গ্রামের এক বাড়িতে টেপ ছিল। সেখানে সন্ধ্যার পরই আমরা বসে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন গান, নাটক, পালা ও খবর শুনতাম।"
তিনি আরও বলেন,"গেল কয়েক বছর ধরে সরকারের সার্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় হারিয়ে গেছে রেডিও। এখন রেডিও টেপ শুনা দূরের কথা, চোখেও দেখিনি।"
দোকানদার আব্দুস সালাম চাকলাদার জানান, "মুক্তিযুদ্ধে রেডিওর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। রেডিও শুনে শুনেই মূলত আমরা যুদ্ধ করতাম। কোথায় কি হচ্ছে তা জানার একমাত্র মাধ্যম ছিল রেডিও।"
তিনি আরও বলেন, "শুধু তথ্য জানার বিষয়ই না। তখন রেডিওতে দেশাত্মবোধক যে গানগুলো দেওয়া হতো সেগুলো শুনতে কেমন যেন দেশের জন্য ভালোবাসা আরও বেড়ে যেত। গান থেকে আমরা যুদ্ধের করার জন্য অনুপ্রেরণা পেতাম।"
শিক্ষিকা মর্জিনা খানম বলেন, "একটা সময় রেডিও, টেপরেকর্ডার ছিল ঘরের সৌন্দর্য। কারো কাছে রেডিও থাকা মানে অর্ধেক পৃথিবী। গান, নাটক, পালা, খবর সব কিছুই পাওয়া যেত এটাতে। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি এটা ব্যবহার হয়েছে। সার্বিকভাবে উন্নয়নে হারিয়ে গেছে রেডিও, নেই টেপরেকর্ডারো।"
Mily