
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় চলমান মানবিক সংকট ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যসহ ২৮টি দেশ। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে ইসরায়েলের ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থাকে ‘বিপজ্জনক’ এবং ‘অমানবিক’ বলে অভিহিত করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গাজার সাধারণ মানুষের ভোগান্তি অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। ইসরায়েলের ত্রাণ বিতরণ মডেল অস্থিরতা তৈরি করছে এবং মানুষের মানবিক মর্যাদাকে খর্ব করছে। খাদ্য ও পানির জন্য অপেক্ষমাণ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে—এটি একটি ভয়াবহ চিত্র। ইতোমধ্যে ৮০০’র বেশি ফিলিস্তিনি ত্রাণের অপেক্ষায় থেকে নিহত হয়েছে।’
বিবৃতিটি স্বাক্ষর করেছেন যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, সুইজারল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডসহ ২৮ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।
শিশুদেরও লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে: ডেভিড ল্যামি
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি পার্লামেন্টে বলেন, ‘গাজায় যা ঘটছে তা এক বিশাল মানবিক বিপর্যয়। ক্ষুধার্ত শিশুদের ওপর বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, গাজায় অতিরিক্ত ৪ কোটি পাউন্ড মানবিক সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি ইসরায়েলের নিরাপত্তার পক্ষে, তবে বর্তমান সরকার যে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, তা ইসরায়েলের মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তীব্র মানবিক সংকট: জাতিসংঘ
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র বলেন, ‘মানবিক পরিস্থিতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যে শেষ অবলম্বনগুলো ছিল, সেগুলোও এখন ধ্বংস হচ্ছে। ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিতে পারে না।’
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) মতে, গাজার ক্ষুধা পরিস্থিতি ‘নতুন স্তরে পৌঁছেছে’, যেখানে অন্তত ৯০ হাজার নারী ও শিশু পুষ্টিহীনতার জরুরি চিকিৎসার অপেক্ষায়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, শনিবার থেকে সোমবারের মধ্যে কেবল অপুষ্টির কারণেই ১৯ জন মারা গেছে।
হাসপাতালেও খাবার নেই, বন্ধ বাজার
দেইর আল-বালাহর আল-আকসা হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. খলিল আল-দাকরান বলেন, ‘রোগী ও কর্মীদের জন্য আর খাবার নেই। স্টাফরা এতটাই দুর্বল যে কাজ চালাতে পারছেন না। শিশুরা খাবারের অভাবে কাঁদছে, দুধ কিংবা ফর্মুলা বাজার থেকে একেবারেই উধাও।’
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ ইমাদ আল-দিন বিবিসিকে বলেন, ‘আমার দুই সন্তান ক্ষুধায় রাতে ঘুমাতে পারে না। গত তিন দিনে শুধু এক প্লেট ডাল খেতে পেরেছে। এক কেজি ময়দার দাম এখন ৮০ ডলার।’
বিতর্কিত GHF এবং সহিংসতা
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গঠিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (GHF)-এর মাধ্যমে বিতরণ করা ত্রাণ কেন্দ্রে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ঘটেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতর জানায়, GHF-এর কেন্দ্রগুলোর আশপাশে গত আট সপ্তাহে অন্তত ৬৭৪ জন নিহত হয়েছে।
শুধু গত শনিবার খান ইউনুস ও রাফার দুটি GHF ত্রাণ পয়েন্টের কাছে ৩৯ জন এবং রবিবার UN কনভয়ের কাছে আরও ৬৭ জন প্রাণ হারান। ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করেছে, তারা ভিড় সরাতে ‘সতর্কতামূলক গুলি’ চালিয়েছিল।
ইসরায়েল বলছে ‘হামাসই দায়ী’
ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমোরস্টেইন এই যৌথ বিবৃতিকে বাস্তবতা বিচ্যুত এবং হামাসের জন্য ভুল বার্তা বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘সব দোষ দেওয়া উচিত হামাসকে, যারা যুদ্ধ শুরু করেছে এবং এখনো শান্তিচুক্তি বা যুদ্ধবিরতিতে রাজি হচ্ছে না।’
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ত্রাণ বিতরণের সময় বেসামরিকদের মৃত্যু হয়েছে বলে তারা স্বীকার করে এবং এ ধরনের ঘটনা কমিয়ে আনতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ফোর্সড ডিসপ্লেসমেন্ট পরিকল্পনা নিয়ে আপত্তি
বিবৃতিতে ২৮টি দেশ স্পষ্ট করে জানিয়েছে, গাজার ২১ লাখ মানুষকে দক্ষিণাঞ্চলের রাফাহ এলাকায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান সিটি’-তে সরিয়ে নেওয়ার ইসরায়েলি প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘স্থায়ী জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।’
সূত্র: বিবিসি।
রাকিব