ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

পারিবারিক পুষ্টি বাগান: স্বাস্থ্য ও সাশ্রয়ের এক অনন্য উদ্যোগ

মাহবুব আলম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া 

প্রকাশিত: ১৭:১০, ২৫ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৭:১৩, ২৫ জুলাই ২০২৫

পারিবারিক পুষ্টি বাগান: স্বাস্থ্য ও সাশ্রয়ের এক অনন্য উদ্যোগ

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।

আমরা সবাই জানি পুষ্টি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মূল শর্ত হল পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, যা শরীরের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বর্তমান সময়ে বাজারের অধিকাংশ খাবার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে উৎপাদিত হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই সমস্যা থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় হল পারিবারিক পুষ্টি বাগান।

পারিবারিক পুষ্টি বাগান কী?

পারিবারিক পুষ্টি বাগান হলো এমন একটি বাগান যেখানে পরিবারের সদস্যরা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী শাকসবজি, ফলমূল ও মসলা উৎপাদন করতে পারে। এটি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর খাবার সরবরাহই করে না, বরং পারিবারিক অর্থনৈতিক সাশ্রয় এবং পরিবেশের সুরক্ষায়ও ভূমিকা রাখে। বাগানটি বাড়ির আঙ্গিনায়, ছাদে, বা বারান্দায় স্থাপন করা যেতে পারে।

পারিবারিক পুষ্টি বাগানের গুরুত্ব:

১. স্বাস্থ্যকর খাবারের উৎস: রাসায়নিক মুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল সরাসরি বাগান থেকে পাওয়া যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

২. অর্থনৈতিক সাশ্রয়: বাজার থেকে শাকসবজি ও ফলমূল কিনতে অর্থ খরচ হয়। কিন্তু নিজস্ব বাগান থেকে ফসল উৎপাদন করলে অর্থ সাশ্রয় হয়।

৩. পরিবেশের সুরক্ষা: নিজস্ব বাগানে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে পরিবেশ দূষণ কমে, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ হয়।

৪. পারিবারিক সম্পর্কের উন্নতি: পরিবারের সদস্যরা একসাথে কাজ করলে বন্ধন আরও দৃঢ় হয় এবং সকলে মিলে প্রকৃতি সম্পর্কে শিখতে পারে।

৫. মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি: বাগান করা মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। এটি একটি মননশীল কাজ যা প্রশান্তি দেয়।

কীভাবে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করবেন:

১. স্থান নির্বাচন: বাড়ির এমন একটি স্থান নির্বাচন করতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পাওয়া যায়। সাধারণত, বাড়ির আঙিনা বা ছাদে বাগান স্থাপন করা হয়।

২. মাটি প্রস্তুতি: মাটির গুণাগুণ ভালো রাখতে জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। মাটি খুঁড়ে ভালোভাবে চাষ করা দরকার।

৩. ফসলের নির্বাচন: মৌসুম অনুযায়ী ফসল নির্বাচন করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, শীতকালে শাকসবজি এবং গ্রীষ্মকালে ফলমূল চাষ করা যেতে পারে।

৪. পরিচর্যা: নিয়মিত পানি দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা এবং প্রয়োজনে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।

বাগানের লে-আউট পরিকল্পনা:

পারিবারিক পুষ্টি বাগানের লেআউট পরিকল্পনা করার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করতে হবে। নিচে একটি সাধারণ লেআউট পরিকল্পনার উদাহরণ দেওয়া হলো:

১. স্থান নির্বাচন: বাড়ির আঙিনা, ছাদ বা বারান্দা যেখানে পর্যাপ্ত সূর্যালোক পৌঁছায়।

২. বেড তৈরি: বাগানের জন্য ৩-৪টি বেড তৈরি করা যেতে পারে। প্রতিটি বেডের প্রস্থ ৩-৪ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ৬-৮ ফুট হতে পারে।

৩. পথ: বেডের মাঝে ১-২ ফুট চওড়া পথ রাখা উচিত যাতে সহজে চলাচল করা যায়।

৪. উচ্চতা: বেডের উচ্চতা ৬-৮ ইঞ্চি রাখা যেতে পারে যাতে পানি নিষ্কাশন ভালো হয়।

বেড তৈরির ধাপ:
১. মাটি প্রস্তুতি: প্রথমে মাটি ভালোভাবে খুঁড়ে নিতে হবে। মাটির সাথে জৈব সার মিশিয়ে নিতে হবে।

২. বেড তৈরি: মাটি সমান করে ৩-৪ ফুট প্রস্থ এবং ৬-৮ ফুট দৈর্ঘ্যের বেড তৈরি করতে হবে। বেডের উচ্চতা ৬-৮ ইঞ্চি রাখা উচিত।

৩. বীজ রোপণ: মৌসুম অনুযায়ী শাকসবজি ও ফলমূলের বীজ বা চারা রোপণ করতে হবে। বীজ বা চারা রোপণের সময় মাটির গভীরতা এবং দূরত্বের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বীজ রোপণের দূরত্ব:

টমেটো: ১৮-২৪ ইঞ্চি দূরত্বে রোপণ করতে হবে।

লাউ: ২৪-৩০ ইঞ্চি দূরত্বে রোপণ করতে হবে।

পালং শাক: ৬-৮ ইঞ্চি দূরত্বে রোপণ করতে হবে।

মরিচ: ১২-১৮ ইঞ্চি দূরত্বে রোপণ করতে হবে।

বাগান তৈরি করার সময় বাগানের আকার ও ফসলের দূরত্ব ঠিক করে নিতে হবে। নিচে একটি সাধারণ উদাহরণ দেওয়া হলো:---------------------------

| টমেটো | পালং শাক | মরিচ | লাউ |
-------------------------------------------
| পথ | পথ | পথ পথ |

-------------------------------------------
লাউ | মরিচ | পালং শাক |টমেটো |
-------------------------------------------

প্রতিটি বেডের মাঝখানে চলাচলের জন্য ১-২ ফুট পথ রাখতে হবে যাতে সহজে চলাচল করা যায় এবং পরিচর্যা করা যায়।

পরিচর্যার মূল কৌশল:

১. সঠিক পানিসেচ ব্যবস্থা: সঠিকভাবে পানি দিতে হবে যাতে গাছের গোড়া ভিজে থাকে। তবে অতিরিক্ত পানি দেওয়া যাবে না।

২. জৈব সার ব্যবহার: রাসায়নিক সার এড়িয়ে জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। বাড়ির জৈব বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট তৈরি করে তা বাগানে প্রয়োগ করা যায়।

৩. পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ: জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

পুষ্টি বাগানে উৎপাদিত ফসল:

বাগানে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ফল এবং মসলা উৎপাদন করা যেতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ- শাকসবজি: বেগুন, টমেটো, লাউ, করলা, পালংশাক, বরবটি ইত্যাদি

ফল: পেঁপে, লেবু, কলা ইত্যাদি

মসলা: মরিচ, রসুন, ধনিয়া পাতা ইত্যাদি

পারিবারিক পুষ্টি বাগান শুধুমাত্র পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণেই নয়, এটি পরিবেশের জন্যও উপকারী। এটি পরিবারের সদস্যদের সাথে একসাথে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে। সঠিক পরিকল্পনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে যে কেউ একটি সফল পুষ্টি বাগান স্থাপন করতে পারে।

রেফারেন্স:

১. কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, বরিশাল। 

২. কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস), বাংলাদেশ সরকার।

৩.বসত-বাড়ির-আঙ্গিনায়-পারিবারিক-পুষ্টি-বাগান-প্রকল্প।

মিরাজ খান

×