ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

নিঃসন্তানতার আঁধার ঘুচিয়ে আশার আলো: আজ বিশ্ব আইভিএফ দিবস

মো: হোসেন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা

প্রকাশিত: ১৬:৪০, ২৫ জুলাই ২০২৫

নিঃসন্তানতার আঁধার ঘুচিয়ে আশার আলো: আজ বিশ্ব আইভিএফ দিবস

ছবি: সংগৃহীত।

সন্তানের মুখ দেখার আকুতি প্রতিটি দম্পতির জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। কিন্তু বন্ধ্যাত্বের অভিশাপে সেই স্বপ্ন যখন ফিকে হয়ে আসে, তখন বিজ্ঞানের হাত ধরে আসে এক আলোকবর্তিকা। সেই আশার আলোর নাম ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা (আইভিএফ)। বিশ্বজুড়ে লক্ষ কোটি নিঃসন্তান দম্পতির মুখে হাসি ফোটানো এই যুগান্তকারী পদ্ধতির সাফল্যের দিনটিই আজ, ২৫শে জুলাই—বিশ্ব আইভিএফ দিবস।

এক বিপ্লবের জন্মকথা-
আজ থেকে ৪৬ বছর আগের কথা। ১৯৭৮ সালের ২৫শে জুলাই যুক্তরাজ্যের ওল্ডহ্যাম অ্যান্ড ডিস্ট্রিক্ট জেনারেল হাসপাতালে জন্ম নেয় বিশ্বের প্রথম আইভিএফ শিশু লুইস জয় ব্রাউন। এই বৈপ্লবিক সাফল্যের পেছনের কারিগর ছিলেন বিজ্ঞানী স্যার রবার্ট এডওয়ার্ডস ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক স্টেপটো। তাঁদের দীর্ঘ দশ বছরের গবেষণা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ছিল এই সাফল্য, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এই যুগান্তকারী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রবার্ট এডওয়ার্ডস ২০১০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। লুইস ব্রাউনের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতেই বিশ্বজুড়ে এই দিনটি পালিত হয়।

সাধারণের কাছে 'টেস্ট-টিউব বেবি' নামে পরিচিত এই পদ্ধতিতে নারীর ডিম্বাণু এবং পুরুষের শুক্রাণু দেহের বাইরে, ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিষিক্ত করা হয়। সৃষ্ট ভ্রূণটিকে কয়েকদিন পর মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়, যা পরবর্তীতে স্বাভাবিক গর্ভধারণের মতোই বৃদ্ধি পায়।
দিবসটির তাৎপর্য 

বিশ্ব আইভিএফ দিবসের মূল উদ্দেশ্য কেবল একটি জন্মদিন উদযাপন নয়, বরং এর তাৎপর্য আরও গভীর। এই দিবসটি পালনের মাধ্যমে বন্ধ্যাত্ব নিয়ে সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কার ও ভুল ধারণার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা হয়। নিঃসন্তান দম্পতিদের বোঝানো হয় যে, বন্ধ্যাত্ব কোনো অভিশাপ নয়, এটি একটি শারীরিক সমস্যা যার আধুনিক ও সফল চিকিৎসা রয়েছে। একই সঙ্গে, এই পদ্ধতির সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কঠোর পরিশ্রম ও অবদানকে সম্মান জানানো হয়।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট:

সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ,সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আইভিএফ প্রযুক্তি আজ আর নতুন নয়। বিগত কয়েক দশকে দেশে এই চিকিৎসাব্যবস্থা অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছে। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে একাধিক আন্তর্জাতিক মানের ফার্টিলিটি সেন্টার, যেখানে হাজার হাজার দম্পতি সফল চিকিৎসার মাধ্যমে সন্তান লাভের স্বপ্ন পূরণ করছেন।

তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইভিএফ চিকিৎসা এখনও অনেকটাই ব্যয়বহুল, যা দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগালের বাইরে। এছাড়া, সামাজিক জড়তা ও তথ্যের অভাবে অনেকেই এই চিকিৎসা গ্রহণ করতে দ্বিধা বোধ করেন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এই বিষয়ে সচেতনতার অভাব প্রকট।
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে রাজধানীর একজন খ্যাতনামা ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ জানান, "বাংলাদেশে আইভিএফ-এর সফলতার হার উন্নত বিশ্বের মতোই। তবে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এর খরচ কমিয়ে আনা এবং তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করা। বন্ধ্যাত্বকে লুকিয়ে না রেখে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে বহু দম্পতিই সন্তানসুখ লাভ করতে পারেন।"

বিশ্ব আইভিএফ দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে কতটা ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে পারে। লুইস ব্রাউনের জন্মের মধ্য দিয়ে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, তা আজ কোটি কোটি পরিবারের অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিয়েছে। বাংলাদেশে এই চিকিৎসার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং সামাজিক কুসংস্কার দূর করা গেলে আরও বহু দম্পতির স্বপ্ন পূরণ হবে। এই দিবসটি বিজ্ঞান, ধৈর্য আর ভালোবাসার এক সম্মিলিত বিজয়গাথা, যা আগামীর পথেও যুগ যুগ ধরে প্রেরণা জোগাবে।

মিরাজ খান

×