ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

বিশ্বজুড়ে যা দুর্ঘটনা, গাজায় তা নিয়মিত ঘটছে!

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১২:৩৭, ২৬ জুলাই ২০২৫

বিশ্বজুড়ে যা দুর্ঘটনা, গাজায় তা নিয়মিত ঘটছে!

ছ‌বি: সংগৃহীত

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব ঘটনা ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে পরিচিত, গাজায় সেগুলো ঘটছে প্রতিদিন, ঘন ঘন এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে। বিমান হামলায় পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে নিহত হওয়া, স্কুলে বোমা পড়া, হাসপাতালের রোগী ও চিকিৎসক একসাথে মারা যাওয়া, শিশুদের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া— এসব পৃথিবীর অন্য যেকোনো জায়গায় বড়সড় মানবিক বিপর্যয় বলে ধরা হয়। অথচ গাজায় এসব এখন নিত্যদিনের চিত্র।

একটি রাষ্ট্র কিংবা সমাজে যদি হঠাৎ একটি বাড়ি ধসে পড়ে এবং তাতে ১০-১৫ জন নিহত হয়, সেটি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দুর্ঘটনা হিসেবে উঠে আসে। সবার সহানুভূতি জাগে, উদ্ধারকাজ শুরু হয়, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।

কিন্তু গাজায় প্রতিদিন শত শত মানুষ মরছে— কেউ ধ্বংস হওয়া বাড়ির নিচে, কেউ হাসপাতাল লক্ষ্য করে চালানো হামলায়, কেউবা খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে গুলি খেয়ে। এসব মৃত্যু এখন যেন একেবারে সাধারণ হয়ে গেছে। মানবতা চোখ বুঁজে ফেলেছে। বিশ্বের অনেক বড় দেশ আর মানবাধিকারের মুখপাত্ররাও মুখে কুলুপ এঁটেছে।

গাজায় শিশুদের মৃত্যু এখন এমন এক স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বিশ্বে কোথাও হলে সবার বিবেক নাড়া দিত। এখানে এক মা নিজের মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন, পাশে আরেকজন বাবা কফিন কাঁধে করে হাঁটছেন— এসব যেন এক ঘোরতর বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি যারা বেঁচে আছে, তারাও জানে না কবে কোন বোমা তাদের শেষ করে দেবে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কোনো শিশু যদি ঘুমাতে না চায়, কারণ সে জানে না সকালে আর জেগে উঠবে কিনা—তাহলে সেই সমাজ কতটা বিপর্যস্ত, তা বুঝে নেওয়া যায়।

বিমান হামলা, ড্রোনের গুলিবর্ষণ, ট্যাংক দিয়ে ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া—এসব তো যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে। কিন্তু গাজায় এটা হচ্ছে আবাসিক এলাকায়, স্কুল-হাসপাতালে, এমনকি জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রেও। যেসব জায়গা সাধারণত যুদ্ধের বাইরে থাকে, যেগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ধরা হয়, সেগুলোও এখানে নিশানায় পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের গুদামঘর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, রেড ক্রসের অ্যাম্বুলেন্সে গুলি চলছে। এমন নির্লজ্জ সহিংসতা আর কোথাও দেখা যায় না।

বিশ্ব যখন বড় কোনো আগুন লাগা, ট্রেন দুর্ঘটনা কিংবা ভূমিকম্পে কাঁদে, গাজায় তখন প্রতিদিনই ১০০টির বেশি পরিবারের পৃথিবী উল্টে যায়। কেউ তার সন্তান হারায়, কেউ তার মা-বাবাকে, কেউ পুরো পরিবারকে একসাথে বিদায় দিতে বাধ্য হয়। একটা মুহূর্তের ভেতরেই সব কিছু ধুলিসাৎ হয়ে যায়। অথচ কোনো নিরাপত্তা বাহিনী নেই, কোনো রক্ষা নেই, কোনো আদালত বা ন্যায়বিচারের সুযোগ নেই।

পৃথিবীর অন্যত্র যেসব ঘটনা ‘খবর’ হয়, গাজায় সেসব ঘটে ‘নিয়মিত’। আর তাই বিশ্ব গণমাধ্যমও অনেক সময় সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখায় না। যেন গাজার মানুষের জীবন তুচ্ছ, তাদের মৃত্যু একেবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সবাই। একদিনে ৪০-৫০ জন শিশু মারা গেলে তা হয়তো এক লাইন খবর হয়, অথচ অন্যত্র এমন হলে রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হতো।

এই অবস্থা শুধু দুঃখজনক নয়, এটা সভ্যতার ব্যর্থতা। যে বিশ্ব মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের কথা বলে, সে বিশ্ব গাজার মানুষদের ন্যূনতম সুরক্ষা দিতে পারছে না। তারা শুধু অস্ত্রের শব্দে ভয়ে কাঁপছে না, ক্ষুধার জ্বালায়ও ছটফট করছে। পানি, বিদ্যুৎ, ওষুধ— সব কিছু প্রায় বন্ধ। চিকিৎসকরা হাতে পঁচে যাওয়া রোগীর পা কেটে ফেলে দিচ্ছেন, কারণ ওষুধ নেই। একসময় যে রোগে মানুষ সহজেই বেঁচে যেত, এখন গাজায় তা নিশ্চিত মৃত্যু।

এই দুর্দশা যদি অন্য কোথাও হতো, তাহলে সেটিকে আমরা ‘বিপর্যয়’ বলতাম। কিন্তু গাজায় এই বিপর্যয় এখন যেন ‘চলমান বাস্তবতা’। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার উদ্বেগ জানায়, কিছু ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়, তারপর আবার চুপচাপ হয়ে যায়। যেন এ এক নাটকের মঞ্চ, যেখানে একই দৃশ্য প্রতিদিন ফিরে আসে, আর দর্শকরা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

গাজা আজ মানবতার চূড়ান্ত পরীক্ষা। এই পৃথিবীতে যারা নিজেদের মানুষ বলে দাবি করে, যারা সভ্যতার, সহমর্মিতার, ও ন্যায়ের কথা বলে, তাদের উচিত চোখ মেলে গাজার দিকে তাকানো। কারণ সেখানে যা ঘটছে, তা আর দুর্ঘটনা নয়— তা মার্কিন-ইসরায়েল পরিচালিত এক পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ। গাজা যেন সেই আয়না, যেখানে আমরা আমাদের বিবেকহীন মুখটি দেখতে পারি। বিশ্বজুড়ে যা দুর্ঘটনা, গাজায় তা এখন জীবনের নিয়ম।

এম.কে.

×