
বগুড়া জেলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বগুড়া জিলা স্কুলে একাধিক গুরুতর অনিয়ম ও অসদাচরণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সহকারী প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আব্দুল মালেক রতনকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে বদলি করা হয়েছে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিষদের এক জরুরি সভায় উপস্থিত ৫১ জন শিক্ষক সর্বসম্মতিক্রমে এই রদবদলের প্রস্তাবে সমর্থন জানান।
অভিযোগে বলা হয়েছে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রস্তুত ও ছাপার নামে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছেন আব্দুল মালেক। সম্প্রতি তৃতীয় শ্রেণির ইংরেজি পরীক্ষায় গুরুতর প্রশ্নপত্র বিভ্রাটের ঘটনায় তার অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার দায় নির্ধারিত হয়। এতে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় এবং পুনরায় প্রশ্ন ছাপাতে বিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি হয়।
একাধিক শ্রেণির প্রশ্নপত্র কাউকে না জানিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করে ছাপানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ের নীতিমালা উপেক্ষা করে তিনি একক সিদ্ধান্ত নিতেন, সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন ও কখনো গালিগালাজপূর্ণ ভাষায় কথা বলতেন। বিদ্যালয়ের অনলাইন পোর্টাল, ফেসবুক পেজ ও অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যম এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তিনি সেখানে ব্যক্তিগত ছবি, সন্তানের কৃতিত্ব এবং বিভ্রান্তিকর পদবি ব্যবহার করতেন। সরকারি চাকরি বিধিমালার ৫ নম্বর ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে তিনি দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব করেছেন।
প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বীর ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে তিনি একাধিকবার সুবিধাজনক বদলি আদায় করেন এবং প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করেন। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়, জেলা শিক্ষা অফিসের সভায় তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে না নামতে শিক্ষকদের চাপ দিতে বলেন, যা সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ রয়েছে, আবদুল মালেক ও তার স্ত্রী (যিনি একই স্কুলে শিক্ষকতা করেন) দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষাসহ প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রমে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করেছেন। তাদের অনুমতি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর হতো না।
এসএম জিয়াউল হায়দার হেনরি, সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক), ২৩ জুলাই ২০২৫ তারিখে স্বাক্ষরিত এক আদেশে মো. আব্দুল মালেককে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে বদলি করে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক (জীববিজ্ঞান) হিসেবে শিবগঞ্জ সরকারি মডেল স্কুল, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদায়ন করা হয়েছে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রমজান আলী আকন্দ বলেন, “সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তপূর্বক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা ও সুশাসন বজায় রাখতে আমরা দায়বদ্ধ।”
আবদুল মালেক রতনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো এখন আর শুধু বিদ্যালয়ের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জাতীয়, স্থানীয় ও দেশের একাধিক অনলাইন পত্রিকায় তার অনিয়ম ও অসদাচরণের খবর প্রকাশিত হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব ও ব্লগসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে ট্রল, সমালোচনা ও ঘৃণাভিত্তিক প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে।
অভিভাবক, শিক্ষক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মতে, এসব ঘটনা বগুড়া জিলা স্কুলের দীর্ঘদিনের গৌরবময় ঐতিহ্যে কালো ছায়া ফেলেছে। তারা অবিলম্বে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষায় এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের “ক্যারিয়ার শিক্ষা” বিষয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে অর্ধেক নম্বর দেওয়ার অভিযোগও ওঠে, যার ফলে অনেক শিক্ষার্থীর ফলাফল খারাপ হয়। এ বিষয়েও আব্দুল মালেককে দায়ী করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আন্দোলনে নামে এবং তার বদলি ও শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে।
প্রশ্নপত্র ত্রুটি, অর্থ আত্মসাৎ, স্বেচ্ছাচারিতা ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে এই বদলি কার্যকর হলেও, বিদ্যালয়ের অভ্যন্তর থেকে অভিযোগ উঠেছে এই ঘটনা যেন বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপে সীমাবদ্ধ না থাকে। তারা আবদুল মালেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করে স্থায়ী শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিও জানাচ্ছেন।
অভিযোগ বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মো. আব্দুল মালেক ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
রাজু