
সমাজে নারীদের যুদ্ধ
পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত চলমান রয়েছে নানা যুদ্ধ, যা আমাদের কাছে দৃশ্যমান। কিন্তু এক প্রকার যুদ্ধ আমাদের নিকট অদৃশ্যমান এবং খুবই নিষ্ঠুরতম, তা হলো সমাজে নারীদের যুদ্ধ। নিজের আপনজনদের নিকট থেকে শুরু করে কর্মস্থল, রাস্তাঘাট এমনকি নিজের মনেও তাদের এই নীরব যুদ্ধ চলমান থাকে। এই অদৃশ্য যুদ্ধ ও অবিচার প্রতিদিন তারা মুখ বুজে সহ্য করে শুধু নিজেকে প্রমাণের চেষ্টায়। নিজের ঘরের দুয়ার থেকেই শুরু হয় এই যুদ্ধ, যেখানে তাকে ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার মাপকাঠিতে প্রতিনিয়ত বিচার করা হয়।
নানান প্রত্যাশা ও নিরাপত্তার আড়ালে লুকিয়ে থাকে বিধিনিষেধের দেয়াল ও নিয়ন্ত্রণ। শৈশব থেকেই শেখানো হয় ‘মেয়ে হয়ে এটা করা যাবে না’, ‘মেয়ে হয়ে চুপ থাকো’, ‘মেয়েদের এত পড়াশোনার দরকার নেই, বিয়ে দিয়ে দাও’ ইত্যাদি। কিন্তু একই ক্ষেত্রে, একজন ছেলে যখন একই কাজ করে তাকে সবাই বাহবা দিয়ে থাকে। এই বৈষম্যমূলক আচরণ থেকেই শুরু হয় মেয়েদের পরিচয় নিয়ে সংকট। পড়ালেখার ক্ষেত্রেও একই বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
আবার, একই ক্ষেত্রে আমরা যদি রাস্তাঘাট ও কর্মস্থলগুলোর দিকে লক্ষ্য করে থাকি, নারীদের প্রতি বৈষম্য এবং নীরব জুলুম। নারীদের রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে হলে, আগে চিন্তা করতে হয় ‘আমি কি নিরাপদ আছি?’ বা ‘আমি কি আমার গন্তব্যস্থলে নিরাপদভাবে পৌঁছাতে পারবো?’। কেননা আমাদের সমাজে নারীরা যেভাবেই চলাফেরা করুক না কেন তাদের আচার-আচরণ এবং প্রতিটি পদক্ষেপ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়। ইভটিজিং বা খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি, সবই যেন নারীদের প্রতি ইঙ্গিত যে, সমাজে এখনো তাদের দমন করে রাখা হয়।
কর্মস্থলেও নারীদের পরিচয় ও অধিকার নিয়ে সংকটে পড়তে হয়। কোনো নারী যদি তার পুরুষ সহকর্মীর থেকে তুলনামূলক বেশি কাজ করেন, তবুও তিনি হয়তো সে পুরুষকর্মীর থেকে কম বেতন পেয়ে থাকেন। কেননা আমাদের এখানে নারীদের অবমাননা করা হয়, তাদের শ্রমকে মূল্যায়ন করা হয় না যথার্থভাবে। পাশাপাশি যৌন হয়রানি এবং বাড়তি সময় কাজ করানো অর্থাৎ অসম আচরণ যেন নারীদের জীবন আরও অতিষ্ঠ করে তোলে। আবার যারা কর্মস্থলে কাজ না করে গৃহিণী হিসেবে থাকেন, তাদের কষ্ট যেন পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকার মতো।
সংসারের সব কাজ, সন্তান লালন-পালন করা থেকে শুরু করে যাবতীয় সব কাজকর্ম করলেও, যেহেতু টাকার বিনিময়ে একজন গৃহিণী সব কাজ করে না, তাই তার শ্রমকে ‘কাজ’ হিসেবে গণ্য করা হয় না। অথচ একজন গৃহিণী তার সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধের ওপর নিয়ে, সকলের ভালো-মন্দের কথা চিন্তা করেন। কিন্তু তাকে অবমূল্যায়ন করার মাধ্যমে তার আত্মসম্মান ধীরে ধীরে ভেঙে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সাইবার অপরাধ বেশিরভাগ নারীদের দিকে লক্ষ্য করেই হয়ে থাকে। যেহেতু, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিপুলভাবে সকলে ব্যবহার করে, তাই নারীরা কোনো মতামত বা ছবি প্রকাশ করলে তাদের নানা বাজে মন্তব্য বা চরিত্রহনন করার অপচেষ্টা চালানো হয়।
বিশেষ করে শিক্ষিত নারী বা তরুণী যখনই তাদের নিজেদের একটি যৌক্তিক মতামত প্রকাশ করে থাকে, একশ্রেণির মানুষ তাদের নানা অপমানজনক কথা বলে থাকে। এ সব কিছু নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। সমাজের এ সব অন্যায় অবিচার যেভাবে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, এতে তারা ধীরে ধীরে ভেতর থেকে নিঃশেষ হয়ে যায়। আত্মমর্যাদাহীনতা, বিষণœতা, উদ্বেগ ইত্যাদি নারীর জীবনকে বিষাদময় করে তোলে।
ফলে মানসিক শক্তির জন্য যখন তারা চিকিৎসা নিতে চায়, তখন ‘এগুলো কোনো সমস্যা না, তুমি বেশি ভাবছো’ বা ‘মেয়েদের একটু সবকিছু মানিয়ে নিতে হয়’ এ ধরনের কথা শুনতে হয়। অনেকে তো এমনকি ‘পাগল’ বলেও সম্বোধন করে থাকে। অথচ যে সব নারী ঘরে-বাইরে কাজ করে, তাদের দায়িত্ববোধ এবং শ্রমের মূল্য সমাজে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
নারীদের এই কষ্ট যেন শোনার মতো কেউ নেই। কেননা, তাদের আপনজন, মা-বাবাই তাদের সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করতে শেখায়। কারণ একজন নারীর অধিকার ও আত্মসম্মান রক্ষার থেকে তার পরিবারের আত্মসম্মান রক্ষা করাটা আমাদের অভিভাবক ও সমাজের নিকট বেশি জরুরি। নিজের অধিকার নিয়ে কথা বললেই ‘বেশি আধুনিক’, ‘বেশি কথা বলে’, ‘বেপরোয়া’ আরও অনেক রকমের নাম ধরে তাকে বলা হয়। নারীর অগ্রগতিতে এসব মনোভাব প্রভাব ও বাধার সৃষ্টি করে। নারীদের এই অদৃশ্য যুদ্ধ আমাদের চোখে পড়ে না। কারণ আমাদের সমাজ চোখে কাঠের চশমা পরে থাকে।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব পরিবর্তন করতে না পারলে নারীদের এই অদৃশ্য যুদ্ধের কোনো সমাপ্তি নেই। নিজের বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সব জায়গায় লিঙ্গসমতার শিক্ষা দিতে হবে। নারীর কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাদের অধিকার আদায়ে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু তাই নয়, কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে এবং নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। নারীদের এই অদৃশ্য যুদ্ধের সমাপ্তির মাধ্যমে সত্যিকারের সমতা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে এবং আমাদের সমাজ মুক্তি পাবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল হু