ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

রকমারি ছিনতাই ॥ প্রতিকার কোন পথে

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ২৬ জুলাই ২০২৫

রকমারি ছিনতাই ॥ প্রতিকার কোন পথে

নগদে চাকরি করে এক কর্মকর্তার কাছ থেকে ছিনতাই করে একটি চক্র

রাজধানীর উত্তরায় গত ১৪ জুন র‌্যাব পরিচয়ে নগদে চাকরি করে এক কর্মকর্তার কাছ থেকে ১ কোটি ৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ছিনতাই করে একটি চক্র। এ ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে ছিনতাই হওয়া টাকার মধ্যে ২২ লাখ ১০ হাজার ৭৮০ টাকা, ব্যাংকে গচ্ছিত ১২ লাখ টাকা ও একটি হায়েস গাড়ি জব্দ করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে চাকরিচ্যুত সেনা এবং পুলিশের কর্মকর্তা। অর্থাৎ এক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জড়িত ছিল, তারাই এখন ছিনতাইকারী। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। ছিনতাইবিরোধী অভিযান কঠোর এবং জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর করতে হবে।
অতীতে ২০২৩ সালে রাজধানীতে ঘোষণা দিয়ে ছিনতাইবিরোধী কঠোর অভিযান পরিচালনা করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ওই সময় প্রথম ১৪ দিনে ৬৭৯ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তারও করেছেন তারা। এটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ ছিল। এ রকম উদ্যোগকে আবারও স্বাগত জানাই। যাতে মানুষ রাস্তায় নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে। পুলিশ কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ রকম কার্যক্রম আবার চলমান থাকবে এটি আমাদের সাধারণ নাগরিকের প্রত্যাশা। কারণ আমরা নানা সময় ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েন।
রাজধানীর শ্যামলীতে সংঘটিত একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে সম্প্রতি; ব্যাপক ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও। ভাইরাল সেই ঘটনায় ঘটে গত ১৩ জুলাই। ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, ওইদিন ভোরের দিকে কাজী অফিসের সামনের রাস্তা দিয়ে ছাতা হাতে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক যুবক। ওই সময় হঠাৎ পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেলে এসে তার পথরোধ করে করেন তিনজন। ভিডিওতে তাদের হাতে ধারালো অস্ত্র দেখা যায়। সেটি দিয়েই ভুক্তভোগীকে জিম্মি করে ভয় দেখায় তারা।
ভাইরাল ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ছিনতাইকারী ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগী যুবকের কাছ থেকে শুধু টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোনই নয়; তার পরনে থাকা জামা ও পায়ের জুতাও খুলে নেয়। কত অসহায় আমরা! কোনো উপায় থাকে না। অনেক মূল্যবান ও আকর্ষণীয় জিনিস তাদের দিয়ে দিতে হয়, এমনকি ছিনতাইকারীর হাতে জীবন দিতে হয়। এসব দুর্ঘটনা খুবই দুঃখজনক। সন্ধ্যা নামলেই ছিনতাই আতঙ্ক নিয়ে চলতে হয় যাত্রী ও নগরবাসীর।

মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ভয়ংকর তৎপর হয়ে উঠছে ছিনতাইকারীরা। অর্থ ও মালপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নৃশংস আঘাতে প্রাণও যাচ্ছে অনেকের। এমন একজন হলেন কলেজছাত্র সাইদ রাকিব। তিনি ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে ২০২৩ সালে ১০ জুলাই খুন হন। অকালে দেশ হারিয়ে ফেলল এক মেধাবী ছাত্র এবং পরিবার তাদের স্বপ্ন হারাল, যে স্বপ্ন একদিন পরিবারের হাল ধরত। এসব মেনে নেওয়া যায় না।
ভয়াবহ ব্যাপার হলো, পুলিশের চলমান অভিযানের মধ্যেই ছাত্রের মৃত্যু হলো। ফলে বর্তমানে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়ে গিয়েছিল। ঢাকায় অনেক অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাতে অফিস করতে হয়, বিশেষ করে সাংবাদিকরা অনেক রাতে অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় ফেরেন। বিভিন্ন সময় ছিনতাইকারীদের হাতে সাংবাদিকদের ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে দেখতে পাই।

তাদের জন্য ছিনতাইয়ের বিষয়টি আরও আতঙ্কের। অনেক যাত্রী বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে আসেন নানা কাজে। যেমন চিকিৎসা, অফিস, চাকরির সন্ধানে। তাদের আসতে অনেকের গভীর রাত বা খুব সকাল হয়। যখনই তারা গাড়ি বা ট্রেন থেকে বাসার উদ্দেশে রওনা হন, তখনই ছিনতাইকারীর হাতে ধরা পড়েন। এ জন্য বাসের কাউন্টার সংলগ্ন টহল বৃদ্ধির পাশাপাশি সব কাউন্টার ২৪ ঘণ্টা খোলা বা সকাল পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি তদারকি বাড়াতে হবে। যাতে দূরপাল্লার যাত্রীরা সকাল হওয়া পর্যন্ত নিজ নিজ কাউন্টারে অপেক্ষা করতে পারেন।গণমাধ্যমে প্রকাশিত ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে- এই পাঁচ মাসে রাজধানী ঢাকায় খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও চুরির মতো অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

গত বছরের তুলনায় মোট অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে হত্যাকা-, যা ২০২৪ এর তুলনায় প্রায় ১৮২ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। রাজধানী ঢাকায় হরহামেশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে এমন অন্তত ২৫টি স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। পল্টন, এয়ারপোর্ট, আসাদগেট, মিরপুর, উত্তরা, মতিঝিল, ওয়ারী, লালবাগ, তেজগাঁও এলাকায় ছিনতাই ও অনুরূপ অপরাধে জড়িতদের সংখ্যা বেশি। 
এখন শুধু ঢাকায় ছিনতাই হয়, তা নয়; চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরে এসব ঘটে থাকে। ময়মনসিংহ শহরে গাঙ্গিনারপার, চরপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই হয়ে থাকে। অনেক সময় রাস্তার মোড়, স্টেশন বা ফুটওভার ব্রিজের নিচে যানজটে আটকা পড়ে অনেক বাস। হঠাৎ বাসের জানালা দিয়ে ছিনতাইকারী যাত্রীদের হাতে থাকা মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ক্রমবর্ধমান আর্থিক ভোগান্তি, বেকারত্ব, যুবকদের মধ্যে হতাশা এসব কারণে ছিনতাইকারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। 
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো মাদক। এসব কারণে অনেক যুবক অপরাধের দিকে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান সমাজে ছিনতাই বৃদ্ধি ইঙ্গিত করে যে, এ ধরনের মাদক সেবনকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকার নির্দিষ্ট এলাকায় অনেক পথশিশু ও তরুণ-তরুণীকে মাদক সেবন করতে দেখা যায়। সরকারকে এই ব্যক্তিদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে যাতে তারা পরিষ্কার ও মাদকমুক্ত জীবনযাপন করতে পারে। চাকরির পাশাপাশি তাদের জন্য একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা অপরাধের জগতে প্রবেশ করবে না। সমাজে মাদক বন্ধ করতে হবে চিরতরে।

মাদক বন্ধ হলে ছিনতাই অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও বলছেন, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ৯০ শতাংশই মাদকাসক্ত। মাদক বন্ধে সরকারের নানামুখী ব্যতিক্রমী জনসচেতনতা কার্যক্রম চালু করতে হবে। আর যেগুলো চালু রয়েছে, সেগুলোর কার্যক্রম বেগবান করতে হবে। ছিনতাইকারীদের ধরতে নিরাপত্তা অভিযানের পাশাপাশি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমন্বিত পদক্ষেপ নিলেই ঢাকার রাস্তা নিরাপদ করা যেতে পারে। রাস্তায় অনেক সময় বিদ্যুৎ চলে যায় যা ছিনতাই বাড়িয়ে দেয়। তাই রাস্তায় বিদ্যমান লাইটের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে রাস্তা সঠিকভাবে আলোকিত করতে হবে। সর্বদা বিদ্যুৎ চলমান রাখতে হবে।

পুলিশকে আরও সতর্ক হতে হবে এবং চিহ্নিত এলাকাগুলোতে, বিশেষ করে লোডশেডিংয়ের সময় ছিনতাইপ্রবণ এলাকায়, নিয়মিত টহল চালাতে হবে। ছিনতাইকারীদের ধরার পাশাপাশি ছিনতাইকারী চক্রের নেতাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশের তালিকাভুক্ত ও গ্রেপ্তার হওয়া ছিনতাইকারীর অধিকাংশের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছর। পুরনো পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি ছিনতাইয়ে প্রতিদিন নতুন মুখ বাড়ছে। নতুন ছিনতাইকারীর সংখ্যা যাতে না বাড়ে, এজন্য আমাদের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 
শুধু সরকার দায়িত্ব নেবে, বিষয়টি এ রকম নয়; আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। পরিবারের ছেলেমেয়ে কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে এসব খেয়াল রাখতে হবে। এখন অনেক তরুণসমাজ মাদকের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যখন তারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে, তখন মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ছিনতাই করতে উৎসাহী হয়ে পড়ে; ভয়াবহ অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে; এমনকি মাদকের কারণে পিতা-মাতাকে হত্যা করতে ভয় পায় না। তাই এসব বন্ধ করার জন্য সমাজের জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক, নাগরিক সমাজ ও শিক্ষকদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে।

এসব ছিনতাইকারী রাজধানীতে তিন ধাপে ভাগ হয়ে ছিনতাই করছে। এর মধ্যে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ছিনতাইকারীরা বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তাই তিন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকি বাড়াতে হবে। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারির অংশ হিসেবে শহরের বিভিন্ন স্থানে ইউনিফর্ম ও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যদের মনিটরিং বাড়াতে হবে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে বর্ধিত সংখ্যক চেকপোস্ট বসানো একান্ত জরুরি। আমাদের সমাজে সমালোচনা রয়েছে যে, ছিনতাইকারী ধরা পড়লেও অনেকেরই বিচার হয় না।

তাই প্রশ্ন জাগে ধরা পড়া এসব অপরাধী প্রকৃতপক্ষে বিচারের মুখোমুখি হয়, নাকি আইনি ব্যবস্থায় অর্থ প্রদান বা ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। যদি তারা প্রাপ্য শাস্তি পায়, তা হলে ছিনতাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। আর যদি তা না হয়, তা হলে তারা অপরাধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহসীবোধ করবে এবং এ ধরনের আরও ব্যক্তি ‘পেশা’ হিসেবে এ কাজে যোগদান করবে। তা খুবই নিন্দনীয়। রাস্তাগুলোর নিরাপদ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে ওই কারণগুলো মোকাবিলা করে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে পুরুষদের মাদক গ্রহণ বন্ধ হয় এবং অন্যান্য অপরাধ প্রথা যেন কমে যায়।

নিষিদ্ধ মাদক, বিশেষ করে ইয়াবার ব্যবহার দেশে উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ছিনতাই ও চুরির মতো অনেক অপরাধমূলক কাজের সূত্রপাত ঘটাচ্ছে। দীর্ঘদিন ‘ইয়াবা’ সেবনে শারীরিক ও মানসিক মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়। এর মরণ ছোবলে জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই ইয়াবার কারবার বন্ধ করতে হবে। যারা ইয়াবা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, তাদের কঠোর আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

প্যানেল হু

×