
ছবিঃ সংগৃহীত
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী উপজেলার নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ার দেখা দিয়েছে। এতে উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। ফসল গেছে পানির নিচে, দুর্ভোগে পড়েছেন হাজারো পরিবার। দীর্ঘদিন ধরে টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় দুর্যোগে ক্ষতির মাত্রা প্রতিবারই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
পানিতে ডুবে গেছে রাস্তাঘাট, স্থানীয় বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অনেক পরিবারের স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বলেশ্বর ও কচা নদীর তীরবর্তী ইন্দুরকানী, পাড়েরহাট, বালিপাড়া, টগড়া, চাড়াখালী, কালাইয়া, ঢেপসাবুনিয়া, সাঈদখালী, চরবলেশ্বর, সাঈদখালী চর, কলারণ, চন্ডিপুর, সেউতিবাড়িয়া, উত্তর ভবানীপুর, গাবগাছিয়া, পত্তাশী, চরনি পত্তাশীসহ অন্তত ২০টির বেশি গ্রাম অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ঢুকে রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু স্থানে।
গাবগাছিয়া গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, “মোগো কোলার বিজ সব তলাইয়া গেছে। ঘরেও পানি উঠছে, রানতে পারি নাই, মাইয়া পোলা লইয়া কি খামু? বেশি পানি অইছে, এ কারণে মোরা মেলা ঝামেলায় পরছি। মোগো দেহার কেউ নাই।”
চাড়াখালী গ্রামের অসহায় নজরুল হাওলাদার বলেন, “মুই মানুষের দ্বারে চাইয়া-চিন্তে খাই, মোর এট্টা মাইয়া আছে, বউও আছে। কোলার মাইধ্যে মোর ঘর, এই ঘরে পানি উঠছে। ঘরে ম্যালা সমস্যা অইছে, ঘরে টিন লাগান লাগবে। কিন্তু মোর দারে তো টাহা নাই।”
একই গ্রামের আকলিমা বেগম নামে এক অসহায় নারী বলেন, “আমার ঘর নাই, আমি মানুষের বাড়ি কাম কইরা খাই। এট্টা বাতরুম নাই, মেম্বার-চেয়ারম্যানরা কোনো কেয়ারই করে না। মোরে ইট্টু সাহায্যের লাইনে দিওন। মুই ম্যালা অসুবিধায় আছি। এই বইন্নার পানিতে ম্যালা ঝামেলায় পরছি।”
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জানান, জোয়ারের পানিতে উপজেলার ৮০ শতাংশ আমনের বীজতলা প্লাবিত হয়েছে। পানি না নামা পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ সম্ভব নয়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, নদীতীর সংরক্ষণের জন্য কোনো টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতিবছরই এমন দুর্যোগে পড়ছে মানুষ। বালির বস্তা ও কাঁচা মাটি দিয়ে সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়।
পাড়েরহাট ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “স্লুইসগেট না থাকায় টগড়া, টেংড়াখালী ও লাহুড়ি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। টগড়ায় যে বেড়িবাঁধ করা হয়েছে, তা ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে টেকসই বেড়িবাঁধ প্রয়োজন।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বা এলজিইডির পক্ষ থেকে এ অঞ্চলে নদীতীর সংরক্ষণের জন্য এখনো কোনো বড় প্রকল্প নেওয়া হয়নি। বরাদ্দের অভাবে এ অঞ্চলের মানুষ যুগের পর যুগ ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চন্ডিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান মঞ্জু বলেন, “ইন্দুরকানী উপজেলার নদীতীরবর্তী এলাকায় যদি পাকা এবং টেকসই বেড়িবাঁধ না হয়, তবে ঘন ঘন দুর্যোগে জানমাল রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এসব এলাকার জন্য দীর্ঘমেয়াদি বাঁধ প্রকল্প সময়ের দাবি।”
ইন্দুরকানী (জিয়ানগর) উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদী বলেন, “জিয়ানগর উপজেলার নদীতীরবর্তী মানুষদের জন্য প্রতি বছরই এই দুর্যোগ যেন এক অলিখিত নিয়তি। অস্থায়ী ব্যবস্থা দিয়ে আর টিকে থাকা সম্ভব নয়। এখনই সময় টেকসই বেড়িবাঁধ, নদী ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসনকে গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করার। নয়তো আগামী বছরগুলোর দুর্যোগে জিয়ানগরবাসী ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে। আমি ইতোমধ্যেই জিয়ানগরের ইউএনও এবং পিরোজপুরের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ডে ইন্দুরকানী উপজেলার টগড়া থেকে কলারণ সন্ন্যাসী পর্যন্ত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য আবেদন করেছি। আশা করছি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অতি দ্রুতই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জিয়ানগরকে রক্ষায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”
ইন্দুরকানী উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মিলন তালুকদার বলেন, “নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্লাবিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছি। পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণ মজুত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করা হবে।”
ইমরান