
কখনো কি কল্পনা করেছেন এমন একটি স্থান, যেখানে শত শত কবর, কিন্তু নেই কোনো আহাজারি, বরং আছে নিঃশব্দ শ্রদ্ধা, শান্তিপূর্ণ নিস্তব্ধতা আর ইতিহাসের ভারবাহী এক অনন্য আবহ? কুমিল্লার ময়নামতিতে অবস্থিত “ওয়ার সেমেট্রি” বা যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র ঠিক এমনই এক জায়গা, যা একসাথে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও শান্তির বার্তা বহন করে।
ইতিহাসের পাতা থেকে...
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯–১৯৪৫) কুমিল্লা ছিল ব্রিটিশ বাহিনীর অন্যতম সামরিক ঘাঁটি। মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা বার্মা ফ্রন্টে (বর্তমান মিয়ানমার) যুদ্ধ করতে এসে এখানে অবস্থান করতেন। কেউ যুদ্ধে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায়, কেউবা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করেন। তাদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ১৯৪৭ সালে গড়ে তোলা হয় ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রি।
এই সমাধিক্ষেত্রটি সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে রয়েছে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন (CWGC)। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে সেমেট্রিটি পরিচালিত হয়।
কারা শায়িত এখানে?
এখানে রয়েছে মোট ৭৩৬ জন মিত্রবাহিনীর সৈন্যের কবর। এদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত এবং পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার সৈন্যরা। প্রতিটি কবরচিহ্নে খোদাই করা রয়েছে তাদের নাম, পদবী ও ইউনিটের পরিচয়। প্রতিটি কবর শুধু পাথরের খণ্ড নয়, প্রত্যেকটি একেকটি ইতিহাস, আত্মত্যাগের স্থায়ী চিহ্ন।
সৌন্দর্য ও স্থাপত্য
সমাধিক্ষেত্রটি সাজানো হয়েছে অত্যন্ত পরিপাটি ও শৈল্পিকভাবে। সবুজ ঘাসে ঢাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে সারিবদ্ধভাবে স্থাপন করা হয়েছে কবরগুলো। মাঝখানে রয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
এই নীরব এলাকাজুড়ে পাখির শব্দ, মনোমুগ্ধকর নিস্তব্ধতা আর ইতিহাসের গন্ধ যেন স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়।
শিক্ষণীয় স্মারক
ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রি কেবল একটি সমাধিক্ষেত্র নয়—এটি একটি জীবন্ত পাঠশালা। এখানে এসে ইতিহাসের বাস্তব শিক্ষা নেওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের জন্য এটি হতে পারে এক অনন্য ভ্রমণ স্থান, যেখানে যুদ্ধের বাস্তবতা, আত্মত্যাগ এবং শান্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব।
পর্যটন ও গুরুত্ব
প্রতি বছর দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক, গবেষক, শিক্ষার্থী ও কূটনীতিকরা এখানে আসেন। বিশেষ করে ১১ নভেম্বর, ‘রিমেম্ব্র্যান্স ডে’ উপলক্ষে আয়োজিত হয় শ্রদ্ধানুষ্ঠান। অজানা বীরদের উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে, দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো হয়, যারা বিশ্ব শান্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।
ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রি কেবল একটি সমাধিস্থল নয়, এটি এক অনন্য নিদর্শন, যেখানে সমাহিত রয়েছে আত্মত্যাগ, ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বের প্রতীক। এটি আমাদের শেখায় শান্তি সবসময় যুদ্ধের চেয়ে উত্তম।
যখনই আপনি কুমিল্লায় যাবেন, সময় করে ঘুরে আসুন এই স্মৃতিস্তম্ভে। হয়তো সেখানে দাঁড়িয়ে আপনি নিজেও বলবেন, “যুদ্ধ নয়, মানবতা হোক বিজয়ের চিহ্ন।”
মিমিয়া