ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২

হারিয়ে যাচ্ছে কাক, নগরের কোলাহলে নিস্তব্ধ এক কাকডাকা ভোর

বদরুল ইসলাম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বরগুনা  

প্রকাশিত: ১৬:০৮, ২৯ জুলাই ২০২৫

হারিয়ে যাচ্ছে কাক, নগরের কোলাহলে নিস্তব্ধ এক কাকডাকা ভোর

ছবি: সংগৃহীত

একসময় শহর কিংবা গ্রামের প্রতিটি সকাল কাকের ডাকেই জেগে উঠত। হঠাৎ খেয়াল করলেই বোঝা যায়—এই চেনা ডাক আজ আর কানে আসে না। কাক কোথায় গেল? আবর্জনা খাওয়া এই উপকারী পাখিটির সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। শহরের আকাশে তাদের উড়াল দৃশ্য যেমন হারিয়ে গেছে, তেমনি গ্রামবাংলার গাছের ডালও এখন কাকশূন্য।

 

কাকের প্রজাতি ও বৈশিষ্ট্য:

বাংলাদেশে প্রধানত দুই ধরনের কাক দেখা যায়—

ঘরের কাক (House Crow)

বন কাক (Jungle Crow)

কাক খুব বুদ্ধিমান ও সামাজিক পাখি। এরা দলবদ্ধভাবে চলে এবং বিপদে একে অপরকে সতর্ক করে। মানুষের ফেলে দেওয়া পঁচা খাবার খেয়ে এরা পরিবেশ পরিষ্কারে ভূমিকা রাখত। এমনকি, এরা মরা পশুর দেহ থেকেও সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি কমাত।


কেন কমে যাচ্ছে কাকের সংখ্যা?

১. আবাসস্থলের সংকট:

নগরায়নের ফলে গাছ কমে গেছে। বৈদ্যুতিক তারে বাসা বাঁধলেও এখন সেই স্থানও বিপদসঙ্কুল।

২. খাদ্য সংকট ও প্লাস্টিক দূষণ:

আগে হাটবাজারে, ডাস্টবিনে সহজে খাবার পেত কাক। এখন এসব জায়গায় প্লাস্টিক, বিষাক্ত রাসায়নিক ও কেমিক্যাল-আবর্জনায় ভরা।

৩. টাওয়ার-তার-কাকের মৃত্যু:

বাড়ছে মোবাইল টাওয়ার, বৈদ্যুতিক লাইনের ঝোপঝাড়। এতে কাক বারবার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়।

৪. সামাজিক-মানসিক বিদ্বেষ:

অনেকেই কাককে 'অপয়া' বা ‘অপ্রয়োজনীয়’ পাখি মনে করে ইচ্ছাকৃতভাবে তাড়িয়ে দেয়, বাসা ভাঙে।

পরিবেশবিদের মতে, “কাকের মতো প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা হারিয়ে যাচ্ছে, এটা আমাদের শহরবাসীর জন্য বিপদসংকেত। কাক শুধু পঁচা খাবার খায় না, এটি পচনশীল দ্রব্য দ্রুত সরিয়ে দেয়, ফলে রোগবালাই কম হয়।

গাছ কেটে কেটে আমরা পাখিদের আশ্রয় কেড়ে নিচ্ছি। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। যেসব খাবারে কাকের টান ছিল, সেখানে এখন থাকে রাসায়নিক আর ফ্লেক্সো-ব্যাগ! ফলে কাক মারা যাচ্ছে, বেঁচে থাকলেও প্রজননে ব্যর্থ হচ্ছে।”


বরগুনা সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের আব্দুল কাদের হাওলাদার (৭৫) নামের একজন বৃদ্ধ বলেন, “আগে আমরা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতাম কাকের ডাকে। উঠানে কেউ পান্তাভাত ফেললেই কাকের দল হাজির হতো। এখন পুরো গ্রামেই যেন কাক নেই। শুধু কাক না, চড়ুই পাখিও কমে গেছে।”


পরিবেশের উপর প্রভাব:

পঁচা মাংস বা মাছের বাজারের আবর্জনা জমে থাকে দীর্ঘসময়।

মৃত প্রাণীর দেহ পড়ে থাকে গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে।

এ থেকে ছড়ায় সালমোনেলা, কলেরা, টাইফয়েডের মতো রোগ।

কাক ছিল এই সমস্যার এক প্রাকৃতিক সমাধান।

করণীয়:

১. শহরে গাছ লাগানো ও সংরক্ষণ:
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গাছ লাগানো কর্মসূচি চালু করতে হবে।

২. ছাদবাগানে পাখির খাবার রাখা:
সাধারণ নাগরিকও চাইলে ছাদে বা উঠানে কিছু খাবার রেখে কাক ও চড়ুই ফিরিয়ে আনতে পারেন।

৩. প্লাস্টিক দূষণ কমানো:
প্লাস্টিক জাতীয় খাবারপাত্র ও প্যাকেট নিষিদ্ধ করা দরকার। জনসচেতনতা জরুরি।

৪. স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষার অংশ হিসেবে পাখি সংরক্ষণ শিক্ষাদান।

৫. স্থানীয় সরকারকে পাখিবান্ধব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উৎসাহ দেওয়া।
যেমন: পাখির জন্য বাসা বানানো, নির্দিষ্ট গাছে বাসা বাঁধা থেকে বিরত না রাখা।

কাক কেবল এক পাখি নয়—এটি আমাদের পরিবেশ, সংস্কৃতি ও স্মৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
'কাকডাকা ভোর' শব্দটি যেন কেবল কবিতায় না থাকে, বরং ফিরে আসুক আমাদের জানালা ধারে, মাঠের গাছে, অথবা মেঘলা দুপুরে। সময় থাকতে সজাগ না হলে, হয়তো আগামী প্রজন্ম কাককে শুধুই বইয়ের ছবিতে চিনবে!

আবির

×