ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২

নেপচুন চা বাগান: সবুজ পাতায় ইতিহাসের গন্ধ

আলী নেওয়াজ অপু, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ফটিকছড়ি

প্রকাশিত: ০২:৪৭, ২৮ জুলাই ২০২৫

নেপচুন চা বাগান: সবুজ পাতায় ইতিহাসের গন্ধ

ছবি : জনকণ্ঠ

বাংলাদেশের পাহাড়ি অঙ্গনে প্রকৃতি যখন আপন ছন্দে গুঞ্জরিত, তখন তার বুক চিরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কিছু অমলিন অধ্যায়—যার একটি হলো নেপচুন চা বাগান। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কোল ঘেঁষে বিস্তৃত এই চা-বাগান শুধু উৎপাদনের পরিসংখ্যান নয়, বরং সময়ের স্রোতে ভেসে আসা এক জীবন্ত ইতিহাস, এক জীবিকা, আর এক আত্মমর্যাদার প্রতিচ্ছবি।

প্রাকৃতিক শোভায় সমৃদ্ধ এক ভূমি

প্রচলিত নগরজীবনের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, যেখানে ভোরের কুয়াশা ধীরে ধীরে পাতার গায়ে জমে যায়—সেইখানে নেপচুন চা বাগান। বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, ঝুলন্ত পাতার সারি আর দূরে পাহাড়ের কুঁচকে থাকা রেখা যেন এক কবিতার পঙক্তিমালার মতো শোভিত করেছে এই বাগানটিকে।

স্থাপিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলে। তবে সময়ের বিবর্তনে আজ এটি ইস্পাহানি গ্রুপের অধীনে পরিচালিত একটি আধুনিক, উৎপাদনক্ষম এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত চা-বাগান।

মানুষের গল্প, পাতার ভাঁজে

নেপচুনের প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এর শ্রমজীবী মানুষের ঘামে। প্রতিদিন ভোরবেলা যখন শহর ঘুমিয়ে, তখন এই বাগানে ঘুম ভাঙে নারী শ্রমিকদের কাঁধে ঝুলানো ঝুড়ির শব্দে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা তুলে আনেন মূল্যবান চা-পাতা, যার সুবাসে সুবাসিত হয় দেশের প্রতিটি কাপ চা।

এই বাগানেরই শ্রমিক জাসমিন আখতার গত বছর ‘সেরা চা সংগ্রাহক’ হিসেবে আঞ্চলিক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর চোখে ছিল গর্ব, কণ্ঠে ছিল নীরব আত্মবিশ্বাস—“আমার হাতের পাতায় যখন ভালো চা ওঠে, তখন মনে হয় দেশের জন্য কিছু করতে পারছি।”

অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও উৎপাদনশীলতা

নেপচুন চা বাগান শুধু চা উৎপাদনের জন্যই পরিচিত নয়, বরং দেশের অর্থনীতিতে এর অবদানও অনস্বীকার্য। প্রতিবছর এখানে উৎপাদিত হয় কয়েক লক্ষ কেজি মানসম্পন্ন চা। এ ছাড়া বাগানে রাবার গাছও রয়েছে, যা থেকে উৎপন্ন রাবার শিট আন্তর্জাতিক বাজারেও যাচ্ছে।

এই বাগান আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা ও ন্যায্য মজুরি প্রদানের দিক থেকেও অগ্রগামী। সরকারের ‘সবুজ কারখানা’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাগানটি ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি পেয়েছে, যা একটি চা-বাগানের জন্য বিরল সম্মান।

সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনার পথ

তবে প্রতিটি সম্ভাবনার সঙ্গে থাকে কিছু চ্যালেঞ্জ। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, প্রশিক্ষিত জনবল সংকট এবং শ্রমিকদের আবাসন ও চিকিৎসার দিকটিতে উন্নয়নের সুযোগ এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতিগত সহায়তা, ইকো-ট্যুরিজমের সম্ভাবনা এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ভবিষ্যতের জন্য এক আশাব্যঞ্জক দিকনির্দেশনা।

নেপচুন চা বাগান শুধু চা পাতার সরবরাহকারী একটি বাগান নয়—এটি এক সাংস্কৃতিক চিহ্ন, জীবিকার প্রতীক এবং ইতিহাসের সাক্ষী। এখানে প্রতিটি পাতা যেন বলে যায় এক গল্প—ঘামের, সংগ্রামের, ভালোবাসার। এই বাগানের মাটিতে যেমন আছে শিকড়, তেমনি আছে ডানা। এখন শুধু দরকার সঠিক পরিকল্পনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্তরিকতার স্পর্শ—যাতে এই ঐতিহ্য শুধু টিকে থাকে না, বরং হয়ে ওঠে আগামী দিনের অনুপ্রেরণা।

Mily

×