
ছবি : সংগৃহীত
হারিয়ে যাচ্ছে পুরোনো দিনের প্রাণখোলা মাঠ আর শৈশবের স্পন্দন।
ঢাকা শহর একসময় ছিল প্রাণচঞ্চল খেলাধুলার কেন্দ্র। শিশুকিশোরদের কণ্ঠে মুখর ছিল অলিগলি, মাঠজুড়ে চলত পিটুল, কাবাডি আর বৌচির মতো লোকজ খেলাধুলা। তবে কালের স্রোতে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং প্রযুক্তির আসক্তিতে হারিয়ে যাচ্ছে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলা। শুধু হারিয়ে যাচ্ছে না প্রায় বিলুপ্তির পথে।
পিটুল বা সাতচারা খেলা ছিল ঢাকার অলিগলির জনপ্রিয় খেলা। ৭টি চ্যাপ্টা ইট বা পাথর স্তূপ করে একটি বল দিয়ে ভাঙা এবং পরে সেই পিটুল গুছিয়ে আনা—এই খেলাটি যেমন শারীরিক চটপটতা বাড়াতো, তেমনি জন্ম দিত টিমওয়ার্কের।
তবে আজ আর সেসব দৃশ্য দেখা যায় না। এখনকার শিশুরা মোবাইল গেম আর ইউটিউবে ব্যস্ত। পাড়ার খেলার মাঠের জায়গা দখল করেছে বহুতল ভবন, পার্কিং আর শপিংমল।
উত্তরার বাসিন্দা ৬৫ বছরের হেলাল উদ্দিন বলেন, আমাদের সময় বিকেল হলেই ছেলেমেয়েরা মাঠে নেমে যেত। পিটুল খেলায় কার কতো দূর থেকে বল ছুঁড়তে পারে, সেটাই ছিল গর্বের বিষয়। এখন তো বাচ্চারা মাঠ চেনে না।
কাবাডি আমাদের জাতীয় খেলা। অথচ রাজধানীতে এখন কাবাডি খেলার সুযোগ পাওয়া যেন ‘আকাশের চাঁদ’।
কাবাডির মূল সৌন্দর্য ছিল দম ধরে প্রতিপক্ষের ঘরে গিয়ে ‘কাবাডি কাবাডি’ বলে ছুঁয়ে আসা যা একদিকে সাহসিকতা, কৌশল ও শক্তির প্রতীক ছিল।
খেলাধুলার প্রেমিক একজন বলেন আগে ঢাকায় কাবাডির ছোট ছোট টুর্নামেন্ট হতো। স্কুল পর্যায়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এখন স্কুলে তো খেলাধুলার জায়গাই নেই। অথচ এই খেলায় আমরা আন্তর্জাতিকভাবেও অনেক সফলতা পেয়েছি।
কাবাডির বর্তমান চর্চা শুধু টিভি পর্দা কিংবা ফেডারেশন কেন্দ্রিক তৃণমূল বা শহরের শিশু-কিশোরদের মধ্যে সেই আগ্রহ আর অনুশীলন নেই।
বৌচি এক সময় ঢাকার মেয়েদের কাছে ছিল সবচেয়ে প্রিয় খেলা। মেয়েরা ছোট দলে ভাগ হয়ে দৌড়াদৌড়ির মাধ্যমে খেলত এই কৌশলনির্ভর দলগত খেলা।
শুধু খেলার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকত না এই খেলায় গড়ে উঠত বন্ধুত্ব, সাহস আর আত্মবিশ্বাস।
উত্তরায় বেড়ে ওঠা লিপি আক্তার বলেন,আমরা প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে বৌচি খেলতাম। গলায় পাড়ার বউদিদের চিৎকার আর হাসির শব্দে পুরো পাড়া মুখরিত হয়ে উঠত। এখন তো বাইরে বের হতেই ভয় পায় মেয়েরা, খেলার কথা কী বলবেন?
ঢাকায় শিশুদের খেলার কোনো নিরাপদ খোলা জায়গা নেই বললেই চলে। এক সময় যেসব জায়গা ছিল খেলার জন্য, আজ তা দখল হয়ে গেছে নির্মাণকাজে, গাড়ির গ্যারেজে কিংবা প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে।
একটা সমাজে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য লোকজ খেলাধুলা অপরিহার্য। কিন্তু আমরা এখন শিশুদের বন্দী করে ফেলছি প্রযুক্তির ছোট পর্দায়। পিটুল, কাবাডি, বৌচি ছিল সামাজিকতা শেখার মাধ্যম তা হারিয়ে যাওয়া মানে সামাজিক বন্ধনও শিথিল হয়ে যাওয়া।
বর্তমান সময়ের শিশুরা জন্ম থেকেই স্মার্টফোনের সঙ্গে পরিচিত। ভিডিও গেম, টিকটক, ইউটিউব এসবই এখন তাদের বিনোদনের মাধ্যম। মাঠ নেই, আগ্রহও নেই। অভিভাবকরাও ভয় পান বাইরে খেলতে দিলে যেন কোনো বিপদ না ঘটে।
সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, সময়ের অভাব, একক পরিবার ব্যবস্থা সব মিলিয়ে আমাদের শিশুরা খেলাধুলার চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ঢাকার পিটুল, কাবাডি, বৌচির মতো ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে কেবল একেকটি খেলার মৃত্যু নয় এটা একেকটি সংস্কৃতির নিঃশেষ হয়ে যাওয়া।
আমরা যদি এখনই না সচেতন হই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব নাম শুনবে কেবল গল্পের বইতে খেলার মাঠে নয়।
Mily