ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

২৫ বছরে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা গেছে ৪২৫ জন ,৫ বছরে বাঘ বেড়েছে ১০ শতাংশ : ২৫ বছরে ৩০ বাঘের মৃত্যু

বাবুল সরদার, বাগেরহাট

প্রকাশিত: ০১:৫৬, ৩০ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০১:৫৬, ৩০ জুলাই ২০২৫

২৫ বছরে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা গেছে ৪২৫ জন ,৫ বছরে বাঘ বেড়েছে ১০ শতাংশ : ২৫ বছরে ৩০ বাঘের মৃত্যু

বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার আব্দুস সামাদ হাওলাদার। আড়াই দশক আগে এক শুক্রবারে সুন্দরবনের গহীনে কাঠ সংগ্রহ করতে যান। দুপুরে খেতে বসার আগমুহূর্তে বাঘের আক্রমণের মুখে পড়েন তিনি। বাঘ গলার নিচে কামড়ে ধরে। শুরু করেন জীবন-মরণ যুদ্ধ। ডাক-চিৎকারের এক পর্যায়ে অন্য বনজীবীরা ছুটে এল বাঘ চলে যায়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর দু’চোখ হারিয়ে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। 

আবার ২০২৩ সালের পহেলা অক্টোবর সকালে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার চারদিন পর সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের তুলাতলা বন থেকে শিপার হাওলাদার নামের এক তরুণ জেলের দেহ বিচ্ছিন্ন মাথা ও প্যান্ট উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। তাদের ধারণা বাঘ তাকে খেয়ে মাথা ফেলে রেখে চলে গেছে। শরণখোলা উপজেলার পশ্চিম রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা শিপারের মৃত্যুতে তার পরিবারে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী মোরশেদা বেগম ও ৫ বছর বয়সী মেয়ে সিনথিয়ার দিন কাটছে নিদারুন অনটনে।

শুধু শিপার বা শরণখোলা উপজেলা নয়, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলার অনেক মানুষই সুন্দরবনের গিয়ে বাঘের আক্রমনে নিহত হয়েছেন। সুন্দরবনে বিভিন্ন সময় এভাবেই বাঘের আক্রমণের শিকার হন বৈধ বা অবৈধ ভাবে প্রবেশকারীরা।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গত ২৫ বছরে (২০০১-২০২৫) সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে ৪২৫ জন মারা গেছেন। এই সময়ে আহত হয়েছেন ৯৫ জন। তবে এর বাইরেও আহত-নিহতদের একটা বড় সংখ্যা রয়েছে যারা বন বিভাগের তালিকায় আসেনি। ২০১১ সালে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নীতিমালা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ ৬৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন আহত ও নিহতদের।

বন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বাঘের আক্রমণে আহত ও নিহতদের পরিবারগুলো খুবই অসহায় হয়ে পড়ে। নানা নিয়মকানুনের বেড়াজালে তারা সরকারি সহযোগিতাও পায় না। আর সরকার যে সহযোগিতা করে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আহত-নিহতের পরিবারগুলোর স্বাভাবিক জীবনের জন্য মাসিক ভাতা প্রদানের দাবি জানান বনজীবী ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

বন্য প্রাণী আইনের মানুষের জান-মালের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা অনুযায়ী, বন্য প্রাণীর আক্রমণে কেউ মারা গেলে ১ লাখ, আহত হলে ৫০ হাজার এবং বাড়ি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হলে ২৫ হাজার টাকা পান।

সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ২০১১ সালে নীতিমালা করে সুন্দরবনে যে কোনো প্রাণীর আক্রমণে আহত, নিহত বা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকার সহযোগিতা শুরু করে। তবে এর অন্যতম শর্ত বৈধ পাসপার্মিট নিয়ে নিয়ম মেনে বনে প্রবেশ করতে হবে। এছাড়া যেসব নারীদের স্বামীরা বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন, তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বিশেষ সহায়তার চেষ্টা করা হচ্ছে। সুন্দরবনে তিনটি খাল রয়েছে, যেখানে শুধু বাঘ-বিধবারাই মাছ আহরণ করতে পারেন।’

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ৫ বছরের ব্যবধানে করা দুটি জরিপের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ বাঘ বেড়েছে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে। প্রকল্পের মাধ্যমে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ, নিরাপত্তা জোরদার, অপরাধীদের যে কোন মূল্যে আইনের আওতায় আনাসহ বিভিন্ন কারণে বনে বাঘ বাড়ছে বলে দাবি বন বিভাগের। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর সুরক্ষা, প্রজনন সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাঘের শিকার প্রাণীর সংখ্যা বাড়ানোসহ সার্বিক নিরাপত্তায় কাজ করা জরুরি। 

২০১৮ সালে জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায়। ২০২৩ সালে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট রেঞ্জের ৬৩৯টি গ্রিডে ক্যামেরা বসিয়ে ফের করা হয় গণনা। ২০২৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় বাঘের সংখ্যা ১২৫। অর্থাৎ ৫ বছরে ১০ শতাংশ হারে বাঘ বেড়েছে।

সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’ এর সমন্বয়কারী নূর আলম শেখ বলেন, বন বিভাগ বাঘ বৃদ্ধির কথা বললেও এই সংখ্যা কোনোভাবেই আশানুরূপ নয়। ২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ অভিবর্তনে বলা হয় ১২ বছরের মধ্যে এর সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে। সেই হিসেবে সুন্দরবনের বাঘ বৃদ্ধির সংখ্যা নগণ্য।’

বাঘের আবাসস্থল নিরাপদ নয় দাবি করে তিনি আরো বলেন, একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত অপরদিকে বিষ দিয়ে অনবরত মাছ নিধন হচ্ছে। এই পানি পান করে বাঘ যেমন অসুস্থ হচ্ছে তেমনি বনের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক চোরাচালান সিন্ডিকেট সুন্দরবনে সক্রিয় আছে। তারা বাঘের দেহাংশসহ বিভিন্ন প্রাণী পাচারে জড়িত। এদের হাত থেকে বন রক্ষা করতে না পারলে বন্যপ্রাণীসহ সুন্দরবনের সংকট দিন দিন বাড়বে বলে মনে হয়।’
এ বিষয়ে বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম করা হয়েছে। এছাড়া খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় বনের ৭৪ কিলোমিটার এলাকা ফেন্সিং করা হচ্ছে, ইতিমধ্যে ৬০ কিলোমিটার কাজ শেষ হয়েছে। আগের চেয়ে বনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, অপরাধীদের ক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি। বন অপরাধে জড়িতদের কোনো ছাড় নেই। সুপেয় পানি, আবাসস্থলসহ বাঘের সুরক্ষায় নেওয়া এসব উদ্যোগের ফলে বাঘ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান তিনি।
 

বাঘ দিবসে সভা-চিত্রাংকন

পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. নূর আলম শেখ বলেন, ‘গত ২৫ বছরে ৩০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ১০টি বাঘের। ১৪টি বাঘকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বাঘ মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসন করে আমাদের সবাইকে বাঘ বন্ধু হতে হবে।’ বিশ্ব বাঘ দিবস উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সকালে বাগেরহাটের মোংলা উপজেলা অডিটোরিয়ামে ‘সুন্দরবন বাঁচাও, বাঘ বাঁচাও’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ ও পশুর রিভার ওয়াটার কিপারের আয়োজনে এ আলোচনা সভা হয়।

সভায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক কৃষিবিদ মোহাম্মদ শামীমুর রহমান শামীম, উপজেলা সমাজসেবা অফিসার এস এম মাসুদ রানা, উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি আহসান হাবিব হাসান, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু হানিফ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সভায় বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও দূষণের কবল থেকে বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে। বিষযুক্ত পানি পান করে বাঘ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। সুন্দরবনের নদী-খালে বিষ প্রয়োগকারী ও বাঘ পাচারকারীদের রুখে দিতে হবে। সুন্দরবন বাঁচলে বাঘ বাঁচবে। সংকটাপন্ন বন্যপ্রাণী বাঘ রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা প্রয়োজন।

অতিথির বক্তব্যে কৃষিবিদ মোহাম্মদ শামীমুর রহমান শামীম বলেন, বাঘ আমাদের গর্বের প্রতীক, সাহসের প্রতীক। জাতীয় ক্রিকেট দলের অফিসিয়াল লোগো হচ্ছে বাংলার বাঘ। বাঘ আমাদের গর্ব, বাঘ আমাদের অহংকার। সুন্দরবন বাঁচলে বাঘ বাঁচবে।

পশুর রিভার ওয়াটারকিপার সুন্দরবন রক্ষায় আমরার সমন্বয়কারী মো. নূর আলম শেখ সভায় সঞ্চালনা করেন। আলোচনা সভা শেষে ‘সুন্দরবনের বাঘ’ বিষয়ক শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করেন কৃষিবিদ মোহাম্মদ শামীমুর রহমান শামীম।

Mily

×