ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

পরিবেশ

পরিবেশ বিভাগের সব খবর

ধনী দেশগুলোর প্রতি ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের জলবায়ু অর্থায়নের দাবী

ধনী দেশগুলোর প্রতি ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের জলবায়ু অর্থায়নের দাবী

বাকুতে চলমান বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৯) বৈশ্বিক দক্ষিনের দেশগুলোর নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কপ-২৯ সমঝোতা থেকে নতুন জলবায়ু অর্থায়ন এর উপর সুস্পষ্ট কর্ম-কাঠামো এবং ধনী দেশগুলোকে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের জলবায়ু অর্থায়নের দাবী করেন। এর পাশাপাশি তারা তারা আলোচনাকে ব্যর্থতায় পর্যাবসিত ও সমাহিত করার জন্য জি-২০ নেতাদের অভিযুক্ত করেছেন, কারন এবারের কপ-২৯ সম্মেলনে তাদের বার্তা ছিলো খুবই সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত বিবরনীর যথেষ্ট ঘাটতি ছিলো, আলোচনায় গভীরতার যে প্রত্যাশা ছিলো তার সলিল সমাধি ঘটেছে বলে তারা উল্ল্যেখ করেন।

শব্দদূষণ ক্রমে বাড়ছে

শব্দদূষণ ক্রমে বাড়ছে

রাস্তায় বের হয়েছেন কিন্তু কান ঝাঁজালো প্রচণ্ড শব্দের সম্মুখীন হয়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। বায়ুদূষণে ঢাকা নগরী যেমন শীর্ষে, তেমনি শব্দদূষণেও পিছিয়ে নেই। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত শব্দদূষণের শিকার হয় তাদের মধ্যে বৃদ্ধ বয়সে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। রাজধানীতে যানবাহন বৃদ্ধির পাশাপাশি শব্দদূষণও বেড়েছে ব্যাপক। দিনে দিনে তা আরও বাড়ছে।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী বিল্লাল হোসেন। তার মতো অনেকেই শব্দদূষণের শিকার। তিনি বলেন, ঢাকার প্রধান নাগরিক সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে- শব্দদূষণ। এই দূষণ শ্রবণজনিত সমস্যা, মাথাব্যথা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া প্রভূতি স্বাস্থ্যগত ও মনোগত সমস্যা সৃষ্টি করে। প্রয়োজন নেই তারপরও হর্ন দেন চালকরা। বিরক্ত হন পথচারী ও সাধারণ মানুষ। আক্রান্ত হচ্ছেন শিশুরাও। চালকদের কেউ কেউ বলেন, মনের অজান্তেই অনেক সময় হর্ন বাজাতে থাকি আমরা, অভ্যাস হয়ে গেছে। কয়েকজন জানালেন, রিক্সাওয়ালাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে হর্ন বাজাই। তারাই বেশি সড়কে বিশৃঙ্খলা করে এখন। স্মুথলি গাড়ি চালাতে পারি না। হর্ন যে স্বাস্থ্যের ক্ষতি, তা আমরা জানতামই না। এ ব্যাপারে আমাদের কেউ সচেতন করেনি। বিআরটিএও কিছু বলেনি। এমনও অনেকে বলেছেন, দীর্ঘক্ষণ যখন সিগন্যালে বসে থাকি, তখন হর্ন দিই, যাতে ট্র্যাফিক পুলিশ সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। বিভিন্ন প্রকার হর্নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর হাইড্রোলিক হর্ন। এই হর্ন গাড়িতে অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে। মোটরপার্টসের দোকানে গেলেই মেলে যে কোনো ধরনের হাইড্রোলিক হর্ন। যদিও ৭ বছর আগেই হাইড্রলিক হর্ন আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে- হাইড্রোলিক হর্ন।  হাইড্রোলিক হর্ন হচ্ছে- উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী বিশেষ হর্ন। আমেরিকান স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (আশা) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, মানুষের জন্য শ্রবণযোগ্য শব্দের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ৪০ ডেসিবল। কিন্তু হাইড্রোলিক হর্ন শব্দ ছড়ায় ১২০ ডেসিবল পর্যন্ত। এর স্থিতি ৯ সেকেন্ডের বেশি হলে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।  কয়েকজন মোটরকার সরঞ্জাম ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অবাধে আমদানি করা হচ্ছে হর্ন। পোর্টে দেখানো হয় খেলনা বাঁশি আমদানি করা হয়েছে। কাস্টমসের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিলে দিয়ে দেয় ছাড়পত্র। যাচাই-বাছাই আর করেনি। প্রতি বছর কী পরিমাণ হর্ন আমদানি করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নে ব্যবসায়ীরা সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিতে পারেননি। একজন মোটরপার্টসের ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, কোন আমদানিকারক ৫ হাজার পিস আমদানি করেন। কেউ আবার ৪ হাজার পিস অর্ডার করেন। যে যেমন পারে। আমাদের দেশে চীন থেকেই বেশি হর্ন আমদানি করা হয়। সড়ক পরিবহন বিধিমালা, ২০২২-এর বিধি-৮১ অনুযায়ী, অ্যাম্বুলেন্স, অগ্নিনির্বাপণ বা উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত মোটরযান অথবা রাষ্ট্রীয় জরুরি কাজে ব্যবহৃত মোটরযান ছাড়া অন্য যে কোনো মোটরযানে বহুমুখী হর্ন অথবা তীব্র, কর্কশ, আকস্মিক, বিকট বা ভীতিকর শব্দের হর্ন কিংবা যন্ত্র সংযোজন বা ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এই বিধিমালার তোয়াক্কা করছে কে! কোনো ক্ষেত্রেই আইন বা বিধির কমতি নেই আমাদের। কিন্তু একে মান্যতা দেওয়া, বাস্তবায়ন করানোর ক্ষেত্রে আমাদের পারদর্শিতা এক প্রকার ব্যর্থ! এই বিধিমালা নিয়েও কথা বলতে হবে। রাষ্ট্রীয় জরুরি কাজে ব্যবহৃত গাড়ি কেন ভীতিকর হর্ন ব্যবহারের সুযোগ পাবে? কোনো প্রয়োজন আছে কি? উন্নত দেশে তো নেই বললেই চলে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে এমন কোনো নজির আছে কী?  রাজধানীর ইস্কাটনের বাসিন্দা সাবরিনা বিনতে আহমেদ। তিনি একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। যাতায়াতের সুবিধার্থে ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত গাড়ি। তিনি জানালেন, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে চালককে অহেতুক হর্ন বাজাতে আমি খুবই নিরুৎসাহিত করি। শব্দদূষণ সৃষ্টির জন্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দায় অনেকখানি। আমরা যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে শব্দদূষণ কমিয়ে আনতে সচেতন হই, তাহলে শব্দদূষণ অনেকাংশেই কমানো সম্ভব। শুধু আইন করেই শব্দদূষণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ঢাকা শহরে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেশি। মালিকরা চালককে যদি সচেতন করেন, ট্র্যাফিক আইন মেনে চলার পরামর্শ দেন, তাহলে ঢাকা শহরে সর্বসাধারণের কিছুটা হলেও স্বস্তিতে চলাচল করার সুযোগ পাবে, এতে কমে আসবে শব্দদূষণের ভোগান্তি। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর খুব আগ্রহ নিয়ে শব্দদূষণ নিয়ে কথা বলেন সার্জেন্ট ইমরান। তিনি দায়িত্ব পালন করেন মগবাজার মোড়ে। ইমরান বলেন, পরিবারের মানুষ জোরে কথা না বললে, কানে শুনি না। ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি হর্নের শব্দ হয় মগবাজার মোড় এলাকায়। এখানে ফ্লাইওভার থাকায় শব্দ প্রতিধ্বনিত হয় বেশি। এই এলাকায় শব্দের মানমাত্রা সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গড়ে ৯০ ডেসিবল। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণক্ষমতা ৪০ ডেসিবল। বিশেষ করে এই এলাকায় বেশ কয়েকটি হাসপাতাল থাকায় গড়ে পাঁচ মিনিট পরপর অ্যাম্বুলেন্স আসা-যাওয়া করে। এই অ্যাম্বুলেন্সে হর্ন বাজানোর ফলে শব্দের ডেসিবল ১১০ হয়ে যায়। যা অসহনীয় ও বিরক্তিকর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রমনা ট্রাফিক জোনের একজন সার্জেন্ট বলেন, হাইড্রোলিক হর্ন যারা ব্যবহার করে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।  ট্র্যাফিক পুলিশ ইচ্ছে করলেই যানবাহন হর্ন বাজানোর ব্যাপারে কঠোর হতে পারে না। আছে আইনগত জটিলতা-তা সমাধান জরুরি। জানালেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক), খোন্দকার নজমুল হাসান। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘হর্নের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। পরিবেশ অধিদপ্তরে আইন ও বিআরটির আইন সংশোধন করলে পুলিশ যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারবে। আইন সংশোধনটা প্রয়োজন। হর্নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে এই আদালত প্রতিদিন বসে না। তারা নির্দিষ্ট কয়েকটি পয়েন্টে মনিটরিং করেন। তাই এর প্রভাবটা ব্যাপক আকারে পড়ে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সড়ক আইন ২০১৮র ৪৫ ধারায় জরিমানার বিধান আছে। ১৮ ধারায় সাজা হিসেবে ১০ হাজার টাকা অর্থদ- করা যায়। তবে মামলা দেওয়ার বিধান নেই।’  পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ সরাসরি পারে না হর্নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। সড়ক আইনে-হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ। ট্রাফিক পুলিশ শুধু হাইড্রোলিক হর্নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। চালকরা সাধারণ হর্ন বাজালে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ শব্দদূষণ আইন-২০০৬ শীঘ্রই সংশোধন করা হবে। সেখানে হর্নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া হবে। তখন অযথা সাধারণ হর্ন বাজালে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারবে।’  পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আমাদের দেশে ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবলের হর্ন আমদানির অনুমতি দেওয়া আছে আমদানি নীতিতে, অথচ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, সর্বোচ্চ অনুমদিত মাত্রা ৭৫ ডেসিবল, যা শিল্প অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য হবে।  আমদানি নীতি ও শব্দদূষণ নীতি ২০০৬ পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। আমদানি নীতি ১০০ ডেসিবলের পরিবর্তে ৫০/৬০ ডেসিবলের হর্ন আমদানির অনুমোদন দিলে শব্দদূষণ সমস্যার অর্ধেক নিরসন হবে। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নির্ভরতায় না থেকে শব্দের উৎস বন্ধের জন্য নীতিগত পরিবর্তন এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ অতি জরুরি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির প্রশিক্ষকদের শব্দ সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য আমাদের শব্দদূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। অনেক চালক হর্ন বাজিয়ে পাশের মানুষকে বিরক্ত করেন। আমরা যদি গাড়ি চালানোর সময় অপ্রয়োজনীয় হর্ন না বাজাই, তাহলে অনেক মানুষের স্বাস্থ্যহানি রোধ করা সম্ভব। উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, রেড লাইট থেকে গ্রিন লাইটে এলেই গাড়ি চালকরা হর্ন বাজানো শুরু করে। এটা উচিত নয়। হর্ন বাজানোর আগে ভাবতে হবে, এটি জরুরি কিনা। এক্ষেত্রে সকল চালককে হর্ন না বাজানোর জন্য সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে, বাচ্চাদের স্কুলে নেওয়ার সময় তারা যে শব্দদূষণের শিকার হয়, তাতে অনেক সময় কানের সমস্যা হতে পারে। তিনি আরও বলেন, ইসলাম ধর্মে  উচ্চৈঃস্বরে নয়, নিচু করে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে মানুষের বিরক্তির কারণ না হয়। আমরা সাধারণভাবে মনে করি, যে যত জোরে কথা বলতে পারে, সে তত শক্তিশালী। কিন্তু আসলে যুক্তিপূর্ণ কথা বলাই আসল ক্ষমতা। আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিবর্তন আনলেই সমাজে ও রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ বিষয়ে বিমানবন্দর সড়কে হর্ন নিষিদ্ধের কথা জানিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, জানুয়ারিতে ঢাকার ১০টি রাস্তা হর্নমুক্ত ঘোষণা করা হবে। দেশকে হর্নমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করা হবে। তিনি বলেন, দেশকে হর্নমুক্ত রাখতে সবাইকে নিজের গাড়ি নিয়ন্ত্রিতভাবে চালাতে হবে। একইসঙ্গে হর্ন ব্যবহার কমাতে হবে।