ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

নীরব ঘাতক ভারী ধাতু এবং  উর্বর মাটির অন্তর্নিহিত বিপর্যয়

অর্ঘ্য প্রতীক চৌধুরী, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বিইউপি

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ৫ জুলাই ২০২৫

নীরব ঘাতক ভারী ধাতু এবং  উর্বর মাটির অন্তর্নিহিত বিপর্যয়

ছবি: জনকণ্ঠ

বাংলাদেশের উর্বর মাটি আজ এক নীরব ঘাতকের কবলে। শিল্পায়নের দৌড়, রাসায়নিক সারের অত্যাধিক প্রয়োগ ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মাটিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে এক ভয়াবহ মারণশক্তি ভারী ধাতু। এই দূষণ নজর এড়ায় সহজে, কিন্তু এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী; এটি ক্ষতিগ্রস্ত করছে ফসল, পরিবেশ এবং সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে মানবস্বাস্থ্যকে।  

ভারী ধাতু কী?
ভারী ধাতু হলো উচ্চ ঘনত্বের ধাতব পদার্থ (যেমন: সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম), যা অতি অল্প মাত্রায়ও প্রাণীদেহে জমে (Bioaccumulate) বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এগুলো মাটিতে শতাব্দীকাল অক্ষয় থাকে, ধীরে ধীরে খাদ্য ও পানীয়জলের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এগুলিকে "Top 10 Chemicals of Public Health Concern" তালিকাভুক্ত করেছে। 

বাংলাদেশে ভারী ধাতু দ্বারা মাটি দূষণ একটি গভীর ও ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত সমস্যা, যার উৎস, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বৈজ্ঞানিক মাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে নথিভুক্ত হয়েছে। 

সীসা (Pb) দূষণের প্রধান উৎস হচ্ছে ব্যাটারি রিসাইক্লিং, যা দেশের মোট সীসা দূষণের প্রায় ৫৮% দায়ী। এছাড়াও, পুরনো সীসাযুক্ত রং, গাড়ির নিষ্কাশন ধোঁয়া এবং সিরামিক শিল্প এটির উৎস হিসেবে বিবেচিত। শিশুদের বুদ্ধিমত্তার স্তর হ্রাস, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি ও গর্ভপাতের মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির সঙ্গে সীসার সংযোগ রয়েছে (CDC, 2022)। ঢাকার শিল্পাঞ্চলের মাটিতে এর মাত্রা WHO নির্ধারিত সীমা (১০০ mg/kg) অতিক্রম করে ১২০ থেকে ৮৯০ mg/kg পর্যন্ত পাওয়া গেছে (WHO, 2023; Bangladesh Journal of Environmental Science, 2020)।

পারদ (Hg) মূলত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যেমন ব্যারাপুর ও পায়রা থেকে নির্গত হয়, এছাড়াও ইলেকট্রনিক বর্জ্য ও ক্লোর-ক্ষার শিল্প এটিকে ছড়িয়ে দেয়। পারদ পরিবেশে মিথাইল পারদে রূপান্তরিত হয়ে মাছের দেহে জমে যায়, যা মানবদেহে প্রবেশ করলে মস্তিষ্ক ও কিডনির ক্ষতি এবং ভ্রূণের বিকলাঙ্গতা সৃষ্টি করতে পারে Minamata রোগ তার একটি উদাহরণ। নারায়ণগঞ্জের মাটিতে পারদের মাত্রা ২.৮ mg/kg যেখানে FAO নির্ধারিত সীমা ০.০৫ mg/kg (UNEP, 2022; Journal of Hazardous Materials, 2021)।

ক্যাডমিয়াম (Cd) প্রধানত ফসফেট সারে উপস্থিত থাকে, যেখানে এর মাত্রা ৬০ থেকে ১৫০ mg/kg পর্যন্ত (IFDC রিপোর্ট)। এছাড়া এটি জিঙ্ক স্মেল্টার ও প্লাস্টিক শিল্প থেকেও আসে। ক্যাডমিয়াম কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট করে, হাড় দুর্বল করে এবং ফুসফুস ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ায়। গাজীপুরে কৃষিজমির মাটিতে এর মাত্রা EU সীমা (১.৫ mg/kg) ছাড়িয়ে ৩.৫ mg/kg পাওয়া গেছে (FAO Soil Bulletin, 2018; Environmental Pollution, 2020)।

ক্রোমিয়াম (Cr), বিশেষ করে হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমিয়াম (Cr⁶⁺), চর্ম ও ধাতব প্রলেপ শিল্পের বর্জ্য থেকে উৎপন্ন হয়। হাজারীবাগ ও সাভারের ট্যানারি এলাকা থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নির্গত বর্জ্য সাভারের মাটিকে ৫,৫০০ mg/kg মাত্রায় দূষিত করেছে, যা WHO নির্ধারিত ১০০ mg/kg সীমার বহু গুণ বেশি (Journal of Leather Science, 2022; WHO IARC Monographs, 2020)। এই ধরণের ক্রোমিয়াম ত্বকে আলসার, DNA ক্ষতি ও ফুসফুস ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।

আর্সেনিক (As) দূষণের মূল উৎস হচ্ছে ভূগর্ভস্থ সেচের পানি এবং পুরনো কীটনাশক, যেমন ডিডিটি। BGS/DPHE এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৫৭% নলকূপে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে, যা চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাটিতে ৪৫ mg/kg পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যেখানে বাংলাদেশে নির্ধারিত সীমা ২০ mg/kg (Lancet, 2019; BGS/DPHE, 2001)। আর্সেনিক ত্বকের ক্যান্সার, যকৃতের রোগ ও হৃদরোগের সঙ্গে জড়িত।

এছাড়াও অন্যান্য ভারী ধাতু যেমন তামা, নিকেল ও বোরন বিভিন্ন শিল্পের টেক্সটাইল রং, কীটনাশক ও প্লাস্টিক অ্যাডিটিভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর প্রভাব যথাক্রমে লিভার সিরোসিস, ত্বকের অ্যালার্জি এবং প্রজনন ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে (EPA IRIS Database, 2023; Journal of Environmental Management, 2021)। এসব বৈজ্ঞানিক তথ্য থেকে স্পষ্ট যে ভারী ধাতু দূষণ শুধুমাত্র মাটি নয়, বরং মানবস্বাস্থ্য, কৃষি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে।

সমাধানের পথ

শিল্পবর্জ্য নিয়ন্ত্রণ: ট্যানারি ও ইস্পাত কারখানায় জিরো লিকুইড ডিসচার্জ (ZLD) সিস্টেম বাধ্যতামূলক করা (নেদারল্যান্ডস মডেল)।  

কৃষি রূপান্তর: জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি (ডেনমার্ক ৮০% জৈব কৃষি), ফসফেট সারের ক্যাডমিয়াম সীমা ২১ mg/kg-এ নামানো (ইউরোপীয় মান)।  

ফাইটোরিমিডিয়েশন: ফাইটোরিমিডিয়েশন হলো এমন একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি, যেখানে গাছপালা ও উদ্ভিদ মাটি থেকে দূষণকারী ভারী ধাতু ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ শোষণ করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়। যেমন, ফাইটোএক্সট্র্যাকশন প্রক্রিয়ায় সূর্যমুখী গাছ সীসা এবং ফার্ন উদ্ভিদ আর্সেনিক শোষণে কার্যকর। 

ফাইটোস্ট্যাবিলাইজেশন:  ফাইটোস্ট্যাবিলাইজেশন পদ্ধতিতে ঘাসজাত উদ্ভিদ মাটিতে ধাতুগুলোকে আটকে রাখে যাতে তা আশেপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে না পড়ে। ফাইটোভোলাটিলাইজেশন কৌশলে কিছু গাছ পারদের মতো ধাতুকে বাষ্পে রূপান্তর করে বাতাসে নির্গত করে দেয়।

এছাড়া ফাইটোডিগ্রাডেশন প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ নিজেই কিছু দূষক রাসায়নিক পদার্থ ভেঙে ফেলে। অন্যদিকে, বায়োরিমেডিয়েশন একটি জীবাণু-নির্ভর পদ্ধতি, যেখানে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক ব্যবহার করে মাটি থেকে ভারী ধাতু বা বিষাক্ত পদার্থ সরানো হয়। উদাহরণস্বরূপ, Pseudomonas প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া আর্সেনিক দূষণ কমাতে, Bacillus ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়াম হ্রাসে, Aspergillus niger ধাতু শোষণে এবং Thiobacillus ferrooxidans খনিজ দূষণ দমনে কার্যকর।  পরিবেশবান্ধব ও টেকসই এই পদ্ধতিগুলো ভারী ধাতু দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর সমাধান হিসেবে বিবেচিত।

মাটির ভারী ধাতু দূষণ কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এটি আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও জিনগত ভবিষ্যৎ-এর প্রশ্ন। শিল্পের দায়হীনতা, কৃষির রাসায়নিক নির্ভরতা ও সরকারি নজরদারির ঘাটতি এই বিষবৃক্ষকে পুষ্ট করছে। সময় এসেছে মাটিকে "আমাদের সেবক" না ভেবে "সুরক্ষিত সম্পদ" হিসাবে চিহ্নিত করার। কারণ, স্বাস্থ্যকর মাটি ছাড়া কোন সভ্যতা টিকে নেই,  ইতিহাস তার সাক্ষী।

শহীদ

×