
বিশ্ববিখ্যাত বিনিয়োগকারী ও “অমাহার ওরাকল” খ্যাত ওয়ারেন বাফেট তাঁর গোটা জীবনজুড়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ, মিতব্যয়ী জীবনধারা এবং বিচক্ষণ বিনিয়োগের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল অর্থসাম্রাজ্য। অথচ তিনি আজও একটি সাধারণ জীবনযাপন করেন। বিলাসিতা, সামাজিক প্রভাব বিস্তার বা তাৎক্ষণিক সুখ লাভের মোহে তিনি কখনোই আটকে পড়েননি।
বাফেটের দৃষ্টিভঙ্গি এক গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা সামনে আনে যাঁরা আর্থিকভাবে সংগ্রাম করছেন, তাঁদের বড় একটি অংশ নিজের অজান্তেই এমন খাতে অর্থ ব্যয় করেন, যেগুলো ধনীদের যেমন এড়িয়ে চলার পরামর্শ, তেমনি এগুলো ভবিষ্যতের সঞ্চয় গিলে ফেলে ধীরে ধীরে। নিচে এমন পাঁচটি সাধারণ খরচের ফাঁদ তুলে ধরা হলো, যেগুলো সম্পর্কে সাবধান না হলে আপনিও হয়তো আজীবন অর্থকষ্টে ডুবে থাকবেন।
১. নতুন গাড়ি কেনা, যেখানে পুরনোই যথেষ্ট
ওয়ারেন বাফেট প্রায় এক দশক চালিয়েছেন ২০০৬ সালের ক্যাডিলাক ডিটিএস। এরপর ২০১৪ সালে গাড়ি পাল্টান, তাও কেবল মেয়ের অনুরোধে। তাঁর মতে, নতুন গাড়ি বিনিয়োগ নয় বরং দ্রুত অবমূল্যায়িত হওয়া সম্পদ। নতুন গাড়ি কিনলেই সেটি দোকান ছাড়ার মুহূর্ত থেকেই মূল্য হারাতে থাকে। অথচ একটি ভালো মানের ব্যবহৃত গাড়িও ঠিক তেমন সেবা দিতে পারে অনেক কম খরচে।
বাফেট এমনকি সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত (hail-damaged) গাড়িও কিনতে দ্বিধা করেন না, যদি দামে সুবিধা পাওয়া যায়। তাঁর মতে, গাড়ি কেবল যাতায়াতের উপায়, স্ট্যাটাসের নয়। নতুন গাড়ির কিস্তি যে কাউকে দেউলিয়া করে দিতে পারে।
২. উচ্চ সুদে ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার
ওয়ারেন বাফেট বারবার সতর্ক করেছেন উচ্চ সুদের ঋণের ভয়াবহতা নিয়ে, বিশেষ করে ক্রেডিট কার্ড ঋণ। তাঁর ভাষায়, “যদি আপনি এমন কিছু কেনেন যেটা আপনার প্রয়োজন নেই, তাহলে খুব তাড়াতাড়িই আপনাকে এমন কিছু বিক্রি করতে হবে যেটা আপনার প্রয়োজন।”
ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার এতটাই বেশি যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে স্টক মার্কেট থেকেও এমন মুনাফা তোলা কঠিন। একবার আপনি ব্যালেন্স রেখে ব্যবহার শুরু করলে, অর্থ সঞ্চয়ের পথ ধ্বংস হয়ে যায়।
বাফেটের পরামর্শ ঋণ করে জীবনযাপন নয়, বরং আয় অনুযায়ী খরচ করুন। প্রথমে সঞ্চয় করুন, বাকি অর্থে খরচ করুন। এই অভ্যাসই ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
৩. লটারি ও জুয়া
ওয়ারেন বাফেটের মতে, “লটারি ও জুয়া হচ্ছে তাদের ওপর কর, যারা অঙ্ক বোঝে না।” অর্থাৎ, এগুলো মূলত গরিব মানুষদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার একটি ব্যবস্থা।
লটারি টিকিট বা ক্যাসিনোর টেবিলে একবারে ছোট খরচ হলেও নিয়মিত এ অভ্যাস ধ্বংস ডেকে আনে। যদি এই অর্থ সঞ্চয় করে বিনিয়োগ করা হয়, দীর্ঘমেয়াদে সেটি বিপুল সম্পদে পরিণত হতে পারে।
বাফেট ঝুঁকি নেয় হিসেব করে, যেখানে ফলাফল আন্দাজযোগ্য এবং দীর্ঘমেয়াদে লাভ নিশ্চিত। জুয়া বা লটারি নয় বরং ধৈর্য, অধ্যবসায় ও সময়ই তাঁর মতে আসল সম্পদ গঠনের উপায়।
৪. অন্যকে দেখিয়ে দেওয়া
বিশাল সম্পদের মালিক হয়েও বাফেট এখনও থাকেন তাঁর পুরনো সাধারণ বাড়িতে। তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপনে আগ্রহী নন, কারণ তাঁর কাছে ‘দেখানোর’ চেয়ে ‘মূল্যবান’ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজে অনেকেই শুধুমাত্র অন্যকে দেখানোর জন্য ব্যয় করেন দামি পোশাক, গ্যাজেট, গাড়ি কিংবা ঘুরতে যাওয়ায়। এতে সাময়িক স্বীকৃতি মিললেও, ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা বিলীন হয়ে যায়।
বাফেটের কাছে প্রকৃত সম্পদ মানে এমন কিছু যা আয় তৈরি করে, খরচ নয়। তাই স্থায়ী আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য গড়তে চাইলে সামাজিক স্বীকৃতির লোভ না করে বিনিয়োগেই মন দিতে হবে।
৫. বাইরে ঘনঘন খাওয়া
বাফেটের পছন্দ খুবই সাধারণ McDonald’s-এর ব্রেকফাস্ট আর চেরি কোক। এর পেছনে কোনো কৃপণতা নয়, বরং সচেতন ব্যয়নীতি।
রেস্টুরেন্টে খাওয়ার খরচ অনেক বেশি। এটি একটি বড় ধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, যা ঘরে রান্না করলে সহজেই এড়ানো যায়। আর সেই বেঁচে যাওয়া অর্থ যদি বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে তা অনেক সম্পদের জন্ম দিতে পারে।
নিজে রান্না করা শুধু খরচ কমায় না, বরং স্বাস্থ্য ও সময়েরও নিয়ন্ত্রণ দেয়। বাফেটের এই দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘমেয়াদে পুঁজি সুরক্ষিত রেখে উন্নয়নের পথ উন্মুক্ত করে।
ওয়ারেন বাফেটের মতে, সম্পদ গড়ার মূল চাবিকাঠি আয় বাড়ানো নয়, বরং আয়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। জীবনের প্রতিটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তেই লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের দিক নির্ধারণের সুযোগ।এই সব ফাঁদ থেকে দূরে থাকলেই দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব।
এই খরচগুলো এড়িয়ে চললে এবং সেই অর্থ যদি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে যে কেউ ওয়ারেন বাফেটের মতো নয়, অন্তত একটি স্থিতিশীল ও স্বাধীন আর্থিক জীবন গড়ে তুলতে পারেন।
সূত্র:https://tinyurl.com/579rv5b2
আফরোজা