
বর্ষাকে প্রকৃতির রানী বলা হয়ে থাকে। বর্ষার রূপ, রস, সৌন্দর্যে প্রকৃতি সজীব হয়ে ওঠে। শিল্পরসিক মন বর্ষার আহ্বানে অভিভূত হয়ে যায়। মনের গতিপ্রকৃতিও তখন কেমন যেনো কাব্যময় হয়ে ওঠে। টাপুর টুপুর বৃষ্টির দিনে বর্ষার গান যখন বেজে ওঠে তখন অন্যরকম একটা মোহমায়া কাজ করে। বর্ষা প্রকৃতিকে সতেজ, সিগ্ধ, কোমল করে তোলে। মরা নদ-নদী, পুকুর-ডোবা, জলাশয় নব আনন্দে জেগে ওঠে। হারানো রূপ, যৌবন পুনরায় ফিরে পায়। প্রাণ ফিরে পায় সবুজ প্রকৃতি। বৃষ্টির পানিতে সবুজ বৃক্ষরাজি আরো সবুজ ও সুন্দর হয়ে ওঠে। টিনের চালে বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দে মন উদাস হয়ে যায়। বর্ষা সবুজ পাহাড়ের সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
বর্ষায় বাহারি রঙের সুগন্ধি ফুল সবার নজর কাড়ে। বর্ষায় হরেক রকমের ফুল ফুটে। তাদের মধ্যে- কদম, কেয়া, জুঁই, চামেলি, জারুল, সোনালু, কলাবতী, রঙ্গন, কামিনী, বকুল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বর্ষার প্রধান আকর্ষণ হলো বৃষ্টিভেজা কদমের মনকাড়া সৌরভ। গাছে গাছে কদমের ডালে ফুটন্ত চমৎকার ফুল সবাইকে আকৃষ্ট করে। কদম ফুলের হালকা সুমিষ্ট ঘ্রাণ সবার মনকে বিমোহিত করে। কদমের এ রূপের কারণে যুগে যুগে কবিরা তাদের কবিতা ও গানে কদম ফুলকে অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
আমাদের সংস্কৃতির সাথে বর্ষা ঋতু ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। ধূলিময়, রুক্ষ-শুষ্ক প্রকৃতিকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিতে বর্ষার জুড়ি নেই। কবিদের কল্পনায় বর্ষা এক অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি। বর্ষার কোমলতা মানুষের হৃদয়কে যেভাবে ছুঁয়ে যায় বাংলার আর কোনো ঋতু এভাবে ছুঁতে পারে না। বর্ষা ছাড়া প্রকৃতি তার পরিপূর্ণতা পায় না।
আষাঢ় ও শ্রাবণ মিলে বর্ষাকাল, যা নিয়ে আসে রিমঝিম বৃষ্টি এবং মুষলধারে বর্ষণ। গ্রীষ্মের ধূলোমলিনতা ধুয়ে প্রকৃতি সবুজের সমারোহে সাজে। বর্ষায় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে প্রচুর বৃষ্টি হয়, চারপাশে সবুজের আভরণ। কদম, বেলি, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে চারপাশ ভরে ওঠে। ময়ূর পেখম মেলে নেচে ওঠে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, আষাঢ়ের আগমনে আকাশ ছেয়ে যায়, বৃষ্টির সুবাস আসে। বাংলাদেশে আষাঢ় মাস দিয়েই বর্ষাকাল শুরু। আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। বাংলা সনের তৃতীয় মাস এটি, যা জুন-জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে পড়ে। পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্র থেকে আষাঢ় নামটি এসেছে।
বর্ষাকাল নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ঋতুবৈচিত্র্যের মাঝে বর্ষা আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে। বর্ষাকাল আবেগ প্রকাশের অন্যতম সময়। কবিরা বর্ষাকে প্রেম-বিরহ ও সৃজনশীলতার ঋতু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। গাছ-পালা, ফুল সবকিছু নতুন করে জীবিত হয়ে ওঠে। প্রকৃতি নতুন সাজে সেজে ওঠে। মানুষের মনে বয়ে আসে নতুন প্রেম। বর্ষার বৃষ্টিতে আবেগ প্রকাশ করতে ভালোবাসে মানুষ। এ কারণে বর্ষাকে নিয়ে অনেক প্রেম ও বিরহের কবিতা লেখা হয়েছে। বর্ষাকে বিরহের কাল বলা হয়ে থাকে।
বর্ষায় দেশের প্রকৃতি অপরূপ সাজে সেজে ওঠে। জুঁই, কামিনী, বেলি, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপার সুবাস চারদিকে মেলে। পদ্মপুকুর রঙিন হয়ে ওঠে। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি জনজীবনকে বিষাদময় করে তোলে। তবুও বর্ষা বাঙালি জীবনে নতুনের আহ্বান। নদী-নালা, খাল-বিল জলে ভরে যায়, মরা নদীতেও জোয়ার আসে। শাপলার হাসি দেখা যায় বিলের জলে।
বর্ষায় নৌকায় চড়ে খাল-বিল পেরিয়ে দূর যাওয়া যায়। সবুজের সমারোহে, মাটিতে নতুন পলির আস্তরণে জীবনের বার্তা আসে। বাংলা মায়ের নবজন্ম হয় বর্ষায়। কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন, ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি। মধ্যযুগে চণ্ডীদাস বর্ষাকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের ইন্ধন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বর্ষা কখনো কোমল, কখনো বিদ্রোহী, কখনো কামনাময়ী, কখনো আনন্দদায়িনী। বর্ষা হাসায়, কাঁদায়, ভাবায়, ভালোবাসায়। বর্ষা আসে, আমাদের ভিজিয়ে রেখে যায়, রেখে যায় অসংখ্য স্মৃতি ও অনুভূতি। বর্ষার ধারায় শুদ্ধ হবে মানবমন, এই আশা নিয়ে আমরা থাকি।
আঁখি