ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

নির্বাক সৌন্দর্যের নীরব বিদায়: হারিয়ে যাচ্ছে সাদা ছোট ঝিনুক

বদরুল ইসলাম , কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বরগুনা

প্রকাশিত: ২১:০২, ২৫ জুন ২০২৫

নির্বাক সৌন্দর্যের নীরব বিদায়: হারিয়ে যাচ্ছে সাদা ছোট ঝিনুক

ছবি: জনকন্ঠ

হারিয়ে যাচ্ছে সাদা ছোট ঝিনুক। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে হেঁটে গেলে এক সময় যে সাদা ছোট ছোট ঝিনুক চোখে পড়ত, আজ তা আর আগের মতো দেখা যায় না। কুয়াকাটা, কচ্ছপতলী, চরপাতা, টেংরাগিরি, শুভসন্ধ্যা কিংবা সুন্দরবনের কাছাকাছি এলাকায় জেলেরা, পর্যটকরা ও স্থানীয়রা বহু বছর ধরে এই ঝিনুক সংগ্রহ, উপভোগ এবং ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিদর্শন।

প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য, যা হারাতে বসেছি

সাদা ঝিনুকগুলো শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং সাগরের পরিবেশগত ভারসাম্যেরও অংশ। এরা বালির মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্ষুদ্র প্রাণীর আবাসস্থল, এবং সাগরের তলদেশে প্রাকৃতিক পরিশোধকের কাজ করে। একেকটা ঝিনুক যেন সাগরের গহীনে থাকা শিল্পীর গড়া এক অমূল্য রত্ন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই অপার সৌন্দর্যের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।

মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ই কি দায়ী?

স্থানীয়দের মতে, অতিরিক্ত জাল ফেলা, ট্রলার ও ট্রলিং নৌকার ব্যবহার, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্যের আধিক্যই এই ঝিনুক হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। আগের মতো আর জোয়ারের পর ভেসে আসা ঝিনুকে ভরা সৈকত দেখা যায় না। এমনকি শিশুরা যেসব সাদা ঝিনুক কুড়িয়ে খেলতো, এখন তা খুঁজে পেতেও কষ্ট হয়।

ঝিনুক নিয়ে ব্যবসা ও শৌখিন সংগ্রহের চাপে

কুয়াকাটাসহ দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় ঝিনুক দিয়ে তৈরি নানা শৌখিন দ্রব্যের চাহিদা বেড়েছে। স্থানীয় দোকানগুলোতে বিক্রির জন্য ব্যাপকভাবে ঝিনুক সংগ্রহ করা হয়েছে বছরের পর বছর। এতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ঝিনুকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির পাশাপাশি তলদেশের বাস্তুতন্ত্রেও পরিবর্তন এসেছে। এতে করে কিছু বিশেষ ধরনের ঝিনুক যেমন—সাদা ছোট ঝিনুক— টিকে থাকতে পারছে না।

সমাধান ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

এই ধ্বংস ঠেকাতে জরুরি কিছু পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে—

1. সচেতন পর্যটন: সৈকতে ঘোরাঘুরির সময় ঝিনুক না কুড়িয়ে বরং প্রকৃতিকে তার মতো করে থাকতে দেওয়া।

2. সমুদ্র জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ।

3. জেলেদের ও স্থানীয়দের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে টেকসই মাছ ধরা ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের শিক্ষা।

4. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা কর্মসূচি।


জলরাশির ধারে বেড়ে ওঠা আমাদের জীবনের অংশ। সেই জলে জন্ম নেওয়া এই সাদা ছোট ঝিনুক আমাদের স্মৃতি, পরিবেশ ও ভবিষ্যতের অংশ। এভাবে যদি তারা হারিয়ে যেতে থাকে, আমরা হারাবো শুধু একটি প্রাণী নয়, বরং একটি প্রাকৃতিক ইতিহাস, একটি সৌন্দর্যচর্চা ও একটি সংস্কৃতি।

সময় এসেছে, ফিরে তাকানোর। প্রকৃতিকে যত্ন না নিলে, একদিন তার সব নিদর্শন শুধু বইয়ের পাতায় বন্দী হয়ে যাবে।

Mily

×