
সিইসির সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত প্রতিনিধি দলের বৈঠক
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা। বুধবার দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে উভয় দলের নেতাদের এই বৈঠক হয়।
বৈঠকে বিএনপি নেতারা অষ্টম সংসদ নির্বাচনের সময়কার সংসদীয় আসন পুনর্বহালের দাবি জানান। তাদের ভাষ্য, দলীয়ভাবে তারা এ বৈঠকে আসেননি। জামায়াত নেতারা দাবি করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে হয়, তাহলে তা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। এ প্রসঙ্গে দলটির মত হচ্ছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলে দলীয় প্রার্থীদের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও মেয়র বানাতে দলীয় প্রভাব কাজে লাগানো হয়। এতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না।
বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করে অষ্টম সংসদ নির্বাচনের সময়কার সংসদীয় আসন পুনর্বহালের দাবি জানান কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের বিএনপির কয়েকজন নেতাসহ বিভিন্ন আসনের প্রতিনিধি দল।
সিইসির সঙ্গে এ বৈঠক শেষে কুমিল্লার প্রতিনিধি বিএনপির সাবেক এমপি উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘১৯৮৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত যেভাবে নির্বাচনী আসন ছিল, আপনারা সেভাবে পুনর্বহাল করেন- এটা আমাদের সার্বজনীন দাবি। আমরা কমিশনের কাছে খসড়া তালিকা প্রকাশের জন্য আবেদন করেছি। নির্বাচন কমিশন আমাদের জানিয়েছে, তারা কাজ করছে। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের আশা পূরণ হবে।’
ইসির সঙ্গে এ বৈঠকটি বিএনপির পক্ষ থেকে নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন আসন থেকে প্রতিনিধিরা এসেছি। আমাদের সবার দাবি হচ্ছে ২০০১ সালের সীমানা অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করা।’
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, ‘২০০১ সালে যেভাবে নির্বাচন হয়েছে, যেভাবে আমরা আসনভিত্তিক নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিলাম, এবারও ঠিক সেভাবে এলাকাভিত্তিক আসনগুলো যেন পুনর্বিন্যাস করা হয়। এ ব্যাপারে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার, সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। তারাও আশ্বস্ত করেছেন অনৈতিকভাবে আসন বণ্টন হবে না, জনগণের চাহিদা মোতাবেক আসন বিন্যাস করে উপহার দেবে।’
বিএনপির এক নেতা মুন্সীগঞ্জের প্রতিনিধি হিসেবে ইসির সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আসন পুনর্বিন্যাস করলে এ নির্বাচন কমিশনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।’
এর আগে, হোমনা ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা-২ আসনটি আগের মতোই রাখার দাবিতে নির্বাচন ভবনের সামনে মানববন্ধন করে একদল লোক।
মানববন্ধনের আগত ৬নং নিলখী ইউনিয়ন পরিষদ যুবদলের আহ্বায়ক রাসেল মাহমুদ জানান, ১৯৫৪ সাল থেকে হোমনা-মেঘনা এক আসনেই ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের তৎকালীন নির্বাচন কমিশন এটি আলাদা করে। ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সেভাবেই ভোট হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে কুমিল্লা-২ আসনটি ফের আগের মতো করা হয়।
যুবদলের এই নেতা বলেন, ‘অর্থাৎ হোমনা-মেঘনাবাসী পুনরায় এক আসনে চলে আসে। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই আবার ২০০৮ সালের অবস্থায় ফিরে যেতে চায়। তাই আমরা সেটা যাতে না করা হয় সে জন্য এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। কুমিল্লা-২ আসনে হোমনা-মেঘনা বহাল রাখার আবেদন করেছি।’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও ২০০৮-২০২৩ সালের সীমানা নির্ধারণে বিতর্কের বিষয়টিও তুলে ধরেছে। সংস্কার কমিশন বলেছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে বিশেষ কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপকভিত্তিক সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ করা হয় ২০০৮ সালে। এ সময় জাতিসংঘের সহায়তায় একজন আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারণ বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দিয়ে একটি গবেষণা করা হয়, যদিও ওই গবেষণার সকল পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সীমানা সংক্রান্ত সংশোধিত আইন হাতে পাওয়ার পর কাজ শুরু করেছে। এখন এ কাজ প্রায় শেষের দিকে। যেখানে। ৭৫টি আসনের ছয় শতাধিক আবেদনও জমা পড়েছে। সংসদীয় এলাকার জিআইএস (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম) সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ উপাত্ত না পাওয়ায় আমাদের সিটি নিতে দেরি হচ্ছে।
এদিকে গত (১৯ জুন) ইসি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘সময়ের অভাবে এবং কিছু উপাত্ত এখনো বাকি থাকায় আলোচনাটা আজ আমরা এগিয়ে নিতে পারিনি। আশা করছি, আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ সংসদীয় আসনের বিষয়টা সম্পন্ন হবে।’
জানা যায়, ১৯৭৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ মোটামুটি একই পদ্ধতিতে হয়। ২০০৮ সালে সীমানা নির্ধারণে জনসংখ্যার ঘনত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। নবম সংসদ নির্বাচনের সময় কোনো জেলার আসনসংখ্যা দুটির কম হবে না, পার্বত্য তিন জেলায় একটি করে এবং ও ক্ষুদ্র জেলা মেহেরপুরে দুইটি আসন বরাদ্দ রাখা হয়। ঢাকায় ১৩টি থেকে আসন হয় ২০টি। ১৯৮৪ ও ১৯৯১ সালের পর ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। দুই বছরের সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ব্যাপক সংস্কার আনা হয় নির্বাচনী সব আইনে। এ ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক ॥ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, আমরা নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা ইসি পুনর্গঠন চাইনি। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের পর নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে, সেহেতু এই কমিশনের আস্থার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। তারা এখনো প্র্যাকটিক্যালি কাজ শুরু করেনি। অতীতের মতো দলীয় সরকারের অধীনে তো এই কমিশনের নিয়োগ হয়নি, এই সরকারের আমলেই নিয়োগ হয়েছে।
বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা বলেন তিনি। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেন- সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, জামায়াত নেতা ও বাংলাদেশ ল ইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার।
ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আমরা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার জন্য বলেছি। নির্বাচনকালীন একটি তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তী সরকার যেটিই হোক, সেটা হবে। এর অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে ভালো হবে। দলীয়ভাবে ভোট হলে দলের সরকার তার প্রার্থী জয়ী করে নেয়। তাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। আমরা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চাই।
তিনি বলেন, নিবন্ধন ও প্রতীকের গেজেট প্রকাশ করে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়ন করেছে ইসি। ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় বেআইনিভাবে নিবন্ধন বাতিল ও প্রতীক কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। চরম অন্যায় করেছিল। কমিশন গেজেট করায় যে প্রত্যাশায় গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তার পূরণ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা ভোটে পিআর (সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি) পদ্ধতি চাই। ঐকমত্য কমিশনেও এ নিয়ে আলোচনা চলছে। আমরা এটার দাবি জানিয়েছি। পরিবেশ সুষ্ঠু না হলে সুষ্ঠু ভোট হয় না, তা অতীতে দেখেছি। পিআর পদ্ধতিতে নমিনেশন বাণিজ্য বন্ধ হয়। আমরা এক শতাংশ ভোটের হারে আসন বণ্টনের কথা বলেছি। ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ বিদেশে। ভোট দিতে পারে না। প্রবাসীরা যেভাবে বাংলাদেশকে বিদেশে উপস্থাপন করেন, রেমিটেন্স পাঠায় তার চেয়ে বড় কথা তাদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ। কমিশন বলেছে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে তারা উদ্যোগ নিয়েছে।
জামায়াতের এই নেতা আরও বলেন, সংস্কার হবে তা যেন কাগজে না হয়। নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে। আশা করি আগামীতে সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যশা পূরণ হবে। যে দাবিগুলোর কথা বললাম তা ইসি রিলেটেড। ঐকমত্য কমিশনের পাশাপাশি ইসিকেও জানালাম।